ঢাকা, শনিবার, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

সবাই চান খালটি ফিরে আসুক

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:২১, জানুয়ারি ২৩, ২০১৭
সবাই চান খালটি ফিরে আসুক দখলমুক্ত হবে নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খাল, কিন্তু কিভাবে?

নিলুনী বেগমের সব জানা। পঞ্চাশোর্ধ নিলুনী এখন নানী হয়েছেন। তবে এই মান্ডা খালে একসময় সাঁতার কেটে বড় হয়েছেন। সেই মুক্তিযুদ্ধের বছর এই এলাকায় আবাস গাড়ে তার পরিবার। এই খালের পানি এতটাই স্বচ্ছ ছিলো তা দিয়েই তাদের রান্না হতো। এই খাল থেকে ধরা মাছ তারা খেতেন।

মান্ডার খালের পাড়েই এখন নিলুনী বেগমের নিজের বাড়ি। জানালেন বছর দশেক আগে জমি কিনে তাদের বাড়ি উঠেছে।

এর আগে থাকতেন আরও ভেতরে গ্রামের দিকটায়।

নন্দীপাড়া থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত মান্ডার খালের এখন চিহ্নটিও বোঝা দায়।

ওয়াসার পুঁতে যাওয়া একটি পিলার দেখিয়ে নিলুনী বেগম বললেন, এই যে দ্যাখেন ওয়াশার পিলার। আমার বাড়ি তার বাইরে। তবে খালের ওপর থেকে আসা একটি ব্রিজের সঙ্গে নিজের ঘরে যাওয়ার একটি ছো্ট্ট সংযোগ পথ রয়েছে তার।
নিলুনী বেগম তার বাড়ির ব্রিজটি ভেঙ্গে ফেলতে প্রস্তুত

এই অংশটুকু খালের সীমানা পিলারের ভেতরেই পড়েছে, সেটি নজরে আনলে নিলুনী জানালেন প্রয়োজনে ওটি ভেঙ্গে ফেলতে তিনি প্রস্তুত। খাল ফিরে আসুক। আবার সেই পুরোনো দৃশ্য দেখতে চান নিলুনী বেগম।

২০০৪-৫ সালেও এই খালে নৌকা আসতো। ‘হাজারমুনি’ (এক হাজার মন ওজন বহনকারী) নৌকা। আম-কাঁঠাল বোঝাই করা বড় বড় নৌকা এসে ভিড়তো এই নন্দীপাড়া বাজারে।

‘এখন সেই খাল কোই, সেই নৌকাও কই?’ আক্ষেপের সুর ঝরলো জাহাঙ্গীরের কণ্ঠে। সিএনজি চালক জাহাঙ্গীর জানালেন এই নন্দীপাড়াতেই তার জন্ম। ধীরে ধীরে একটি গ্রামকে শহরে পরিণত হতে দেখেছেন। আর দেখেছেন একটি খাল কিভাবে কারা দখল করে হত্যা করেছে।

ময়লা ফেলে আটকে দেওয়া হয়েছে ব্রিজের এপাশওপাশ

বললেন, সবই আমাদের চোখের সামনে হয়েছে। তবে সে জন্য এলাকার আদি নিবাসীদের নয়, জাহাঙ্গীর দুষতে চান যারা পরের দিকে এখানে জমি কিনে বসত গেড়েছেন তাদের।

বললেন, এরা কেউ কেউ খালপাড়ের সড়কের এপাড়ে জমি কিনেছেন। সেখানে বাড়ি করে ঠিক তার উল্টোদিকে খালটিও যেনো তার কেনা! এমন চিন্তা থেকে খালের অংশ দখল করে নিয়েছেন। এটা তো হতে পারে না, কিন্তু তাই হয়েছে, মত জাহাঙ্গীরের।

যেখানে বসে কথা হচ্ছিলো সেটি একটি সিএনজি স্টেশন। নন্দীপাড়া বাজারের ঠিক মুখে খালের প্রায় সবটা দখল ও ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে এই সিএনজি স্টেশন। তারই একটি সিএনজি চালান জাহাঙ্গীর। নিজেই দেখিয়ে দিলেন কিভাবে এলাকার একজন প্রভাবশালী এই খাল ভরাট করে স্টেশন বানিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো আলম নামে ওই প্রভাবশালী এলাকায় বেশ জমি কিনে নিয়েছেন আর তিনিই দখল করে ভরাট করে ফেলেছেন খালের এই অংশ। নন্দীপাড়া বাজার থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত মান্ডা খালের মধ্যে এটিই ছিলো সবচেয়ে ন্যাক্কারজন দখলদারীত্ব।

খাল ভরাট করে সিএনজি স্টেশন

তবে একটু সামনে এগিয়ে নন্দীপাড়া বাজার সেতুর দুই দিকটিও দেখা গেলো ভরাট হয়ে আছে। একদিকে এলাকাবাসী ময়লা ফেলে ফেলে ভরিয়ে ফেলেছেন। খালের পাশের দোকানি বললেন, আমি যখন দেখি তখন আটকাই কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবাই পোটলা ভরে ময়লা এনে এখানে ফেলে। আর ধীরে ধীরে তা খাল ভরিয়ে ফেলেছে। এখন আর এখান থেকে পানি যেতেই পারে না।

কে কোথায় কি ফেলছে তা দেখার কেউ নেই। আর সে কারণেই ধীরে ধীরে এই খাল মরে গেছে, এমনই মত একটি ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে বিকেলের আড্ডায়রত তিন বন্ধুর। সৈয়দ আবদুস সোবহান, মাসুদুর রহমান ও মোর্শেদ আলম। তিনজনই পেশায় ব্যবসায়ী।
তিন বন্ধুই খাল উদ্ধারের পক্ষে

কথা পারতেই বললেন, এইসব জায়গায় এক সময় কি না হইছে। আমরা এই খালে আমরা সাঁতার কাটতাম, মাছ ধরে খেতাম। সব বড় বড় নৌকা আসতো। ব্রিজের পাশে একসময় চল্লিশ ফুটের খাল ছিলো, এখন তার চিহ্নই নেই। খাল মাইরা দোকানপাট কইরা ফালাইছে।

জানেন, একসময় এই নদীতে নৌকাবাইচ হইতো, বলেন এই বন্ধুরা।

এরাও বললেন, দখলদারদের অনেকেই বাইরে থেকে আসা। এরা কেউ এলাকার নন। এলাকাবাসী চান যাতে পুরো অঞ্চলটি সুন্দর থাকে।

সুয়ারেজ লাইন এই খালের ভেতর নামিয়ে দেওয়াতে এর সব মাছ মরে গেছে, বলেও দাবি করেন তারা। বলেন, ময়লা এসে জমে থাকে। আর যখন বর্ষার পানি এসে ভরে যায় তখন ওভারফ্লো করে চলে যায়। তাদের প্রত্যেকেরই দাবি পানি ফিরে আসুক তারা আবার মাছ ধরতে চান এই খালে। ছোটবেলায় ফিরে যেতে চান।

বন্ধুদের একজন বলেন, জানেন এই খাল আমাদের অনেক কিছু দিতো। কখনোই মাছ কিনে খেতে হয়নি।

ত্রিমোহনী এলাকার রহিম মিয়া জানালেন ৮/১০ বছরে আগেও এই খালে গলাপানি ছিলো। আর ২০ বছর আগে তো এই খাল ধরে নৌকা নিয়ে জিঞ্জিরা হাটে গেছেন তিনি।

এই খাল ধরে নৌকা নিয়ে জিঞ্জিরা হাটে গেছেন রহিম মিয়া

ইব্রাহীম নামে অপর একজন জানালেন, মাছ মারা তার পেশা। একসময় এই খাল শত শত মানুষের জীবিকার উৎস ছিলো। ‘এই খালে মাছ মেরে খেতাম। এখনো মাছ মারি। তবে যে হয় দূরের কোনও নদী কিংবা বিলে,’ বলেন ইব্রাহীম।

এরা সবাই চান তাদের খালটি ফিরে আসুক।

গত ২২ জানুয়ারি (রোববার) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাইদ খোকন রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল, বক্সকালভার্ট ও রাস্তা অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য ঘোষণা দেন। প্রাথমিকভাবে আগামী ৬ এবং ৯ ফেব্রুয়ারি নন্দীপাড়া ত্রিমোহিনী খাল ও হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার রাস্তা অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য অভিযান চালানো হবে বলে জানান তিনি।

ঢাকা শহরের খাল ও বক্সকালভার্টগুলো অবৈধভাবে দখল করে ভরাট করায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে প্রতি বছর। তাই মেয়রের ঘোষণাকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন। কেউ কেউ সাহসী বলছেন। কেউ বলছেন অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত কি হয়, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।

বাংলাদেশ সময় ০৯৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৭
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।