ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ মে ২০২৪, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

ফিরে দেখা-২০১৫

সহিংস ‘আন্দোলন’ মোকাবেলায় শুরু, রেকর্ড বিজয়ে শেষ

শামীম খান, মহিউদ্দিন মাহমুদ ও সালাহউদ্দিন জসিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০১৬
সহিংস ‘আন্দোলন’ মোকাবেলায় শুরু, রেকর্ড বিজয়ে শেষ

ঢাকা: নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও ব্যাপক সফলতার মধ্য দিয়ে আরও একটি বছর পার করলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের সংকট মোকাবেলা দিয়ে শুরু করে ২০১৫ সাল শেষ করেছে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রেকর্ড বিজয়ের মধ্য দিয়ে।



টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর সরকারের এক বছর পার হতেই এ বছরের শুরুতে বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ‘আন্দোলনে’ ব্যাপক প্রাণহানি ও সহিংসতা ঘটে। একে কেন্দ্র করে চাপের মধ্যে পড়তে হয় সরকারকে।

এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে না আসতেই শুরু হয় ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড। ব্লগার, মুক্তমনা লেখক-প্রকাশকদের প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। পুলিশও এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। হত্যা করা হয় দুই বিদেশি নাগরিককে। ঢাকার হোসেনি দালানসহ বেশকিছু স্থানে বোমা-গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে, হতাহত হন বেশ কয়েকজন।

এসব ঘটনায় সরকারকে বার বার বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। কখনও কখনও চাপের মধ্যেও পড়ে সরকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেতে হয়।

এসব ঘটনার বাইরে আবার আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরেও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে এসব অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা ঘটে।

বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর।

বছরের শুরুতেই চাপের মুখে
গেলো বছরের শুরুতেই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নাশকতা নিয়ে সরকার কঠিন চাপের মধ্যে পড়ে। সরকারের চলতি মেয়াদের এক বছর পূর্তির প্রাক্কালে ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিন হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যায় বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোট। বিএনপি-জামায়াতের এ কর্মসূচি নাশকতা ও সহিংসতায় রূপ নেয়।

হরতাল-অবরোধ চলাকালে যানবাহনে পেট্রোল বোমা ছোড়া হয়। এতে দেড় শতাধিক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। সহস্রাধিক মানুষ আহত হন। মানুষের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে মারাত্মক হিমশিম খেতে হয়।  

দলীয় নেতাকর্মীদের অপকর্ম
প্রায়ই দলের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় সরকার ও আওয়ামী লীগকে। ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন এবং এমপিরা একের পর এক নানা ঘটনার জন্ম দেন। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, হত্যাকাণ্ড, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী তৎপরতায় ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে।

সংরক্ষিত নারী আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি পিনু খানের ছেলে রাজধানীতে দুই শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করেন। ১০ জুন রাজধানীর শ্যামপুরে জোট শরিক জাতীয় পার্টির এমপি (ঢাকা-৪) আবু হোসেন বাবলার কার্যালয়ে হামলা, গুলি ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। আবু হোসেন বাবলা ও সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের এমপি সানজিদা খানমের সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে এ ঘটনা ঘটে।

১৪ মে টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এক ছাত্র নিহত ও দু’জন আহত হন। ১২ এপ্রিল কুমিল্লায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নিহত হন। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দু’জন নিহত হন।

কক্সবাজার-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা, মাদক ব্যাবসা, মানবপাচারসহ নানা অভিযোগ এসেছে বিভিন্ন সময়।

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী এবং মহানগর সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হুমকি ও লাঞ্ছিত করেন।

রাজধানীর বাড্ডায় ঝুট ব্যবসা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন নেতা হত্যা, জাতীয় শোক দিবসের দিন কুষ্টিয়ায় এক যুবলীগ নেতা হত্যা, চাঁদপুরের কচুয়ায় চাঁদার দাবিতে স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রীদের ওপর যুবলীগের হামলা, রাজধানীর হাজারীবাগে ছাত্রলীগ নেতার হাতে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।

মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত ও মায়ের পেটে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।

একের পর এক এসব ঘটনার মধ্যে সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর নির্দেশ দেয়। এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে কয়েকজন মারা যান।

তিন সিটি করপোরেশন ও পৌর নির্বাচন
চলতি বছর গোড়ার দিকে তিন সিটি করপোরেশন আর শেষদিকে অনুষ্ঠিত হয় দলীয়ভাবে ২৩৪ পৌরসভার নির্বাচন। ২৮ এপ্রিলের ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং ৩০ ডিসেম্বরের পৌরসভা  নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল পায় রেকর্ড বিজয়।

সিটি নির্বাচন ছিলো সরকারের এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল। বিএনপি-জামায়াতকে আন্দোলন-নাশকতা থেকে সরিয়ে নির্বাচনে নিয়ে আসার কৌশল ছিলো এ নির্বাচন। তবে বিএনপি শেষ মুহূর্তে এসে নির্বাচন বর্জন করে।

অন্যদিকে তফসিল ঘোষণার পর থেকে শেষ পর্যন্ত পৌর নির্বাচনের মাঠে ছিলো বিএনপি।

আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন এবং তা বানচালের চেষ্টা করে বিএনপি জোট। নির্বাচনের এক বছর পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে আন্দোলন-জ্বালাও-পোড়াও নাশকতা চালায়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিয়ে আসতে পারা ছিলো আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এক ধরনের সফলতা। আর অস্তিত্ব রক্ষায় নিজে থেকেই পৌর নির্বাচনে অংশ নেয় দলটির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট।

সীমান্ত সমস্যার সমাধান
ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা সীমান্ত সমস্যার সমাধান হলো গেলো বছরে। ৭ মে ভারতের পার্লামেন্টে (লোকসভা) সীমান্ত বিল পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৬৮ বছরের এ সমস্যার অবসান ঘটার পথ সুগম হয়।

প্রায় সাত দশক ধরে নাগরিকত্ববিহীন দুই দেশের সাড়ে ৫৫ হাজার মানুষের বঞ্চনা, কষ্ট আর ভোগান্তির অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবে রূপ পায় ৩১ জুলাই মধ্যরাতে। দুই দেশের মধ্যে ১৬২টি বিলুপ্ত ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়। সেখানকার মানুষদের নাগরিক পরিচয় নিশ্চিত হয় এবং এক ধরনের বন্দিদশা থেকে তারা মুক্ত হন।

এটা ছিলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বড় ধরনের কূটনৈতিক সফলতা।

মোদির ঢাকা সফর
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর ছিলো বহুল আলোচিত ঘটনা। মোদির এ সফর সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য ছিলো অত্যন্ত ইতিবাচক। এ সফরের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনের আবারও বহির্প্রকাশ ঘটে।

প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বাধার মধ্যে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিলো গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন। ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশের এ নির্বাচনকে সমর্থন দিয়ে আসছিলো। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এর পর পরই ভারতে ক্ষমতার পালাবদল হয়। সাধারণ নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পরাজিত হয়। ক্ষমতায় আসে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি(বিজেপি)। নতুন সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা ও গুঞ্জন চলতে থাকে। ক্ষমতায় আসার এক বছর পর মোদীর ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সেই জল্পনা, কল্পনা ও গুঞ্জনের অবসান ঘটে।  

ত্রাণমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী নিয়ে সমালোচনার ঝড়
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মন্ত্রিত্ব থাকা না থাকা নিয়ে শুরু হয় নানা বিতর্ক। ২০০৮ সালে জ্ঞাত আয়ের বাইরে অবৈধভাবে ৬ কোটির বেশি টাকার সম্পদ অর্জনের মামলায় ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ২০১০ সালের অক্টোবরে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই রায় বাতিল করেন। দুদক এর বিরুদ্ধে আপিল করে।

বিদায়ী বছরের ১৪ জুন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে আপিলের পুনঃশুনানির নির্দেশ দেন। এরপর মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মন্ত্রিত্ব থাকা, না থাকা নিয়ে শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিষয়টি সরকার ও আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।

একই সময়ে সরকারকে বিব্রত করেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামও। ব্রাজিল থেকে পঁচা ও খাওয়ার অযোগ্য গম আমদানির অভিযোগ ওঠে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। গম ক্রয়ের পেছনে অভিযোগ ওঠে দুর্নীতিরও। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন কামরুল ইসলাম। বেশ কিছুদিন ধরে চলে তোলপাড়, বিষয়টি গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত।

সংসদ থেকে লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগ
আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত নেতা প্রবীণ রাজনীতিবিদ আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা ১৭টি মামলায় কয়েক মাস জেলে থাকার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে মুক্তি পান ২৯ জুন। এরপরই তার সংসদে যাওয়া না যাওয়া এবং সদস্য পদ থাকা নিয়ে নানা বিতর্ক শুরু হয়। এ নিয়ে আইনি বিতর্কের মুখে নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে অংশ নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন লতিফ সিদ্দিকী। এর কয়েকদিনের মধ্যে সংসদে উপস্থিত হয়ে পদত্যাগ করেন তিনি।

সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় পরিবর্তন
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল  ইসলামের মন্ত্রণালয় পরিবর্তন ছিলো রাজনৈতিক অঙ্গণসহ বিভিন্ন মহলে বহুল আলোচিত ঘটনা।

৯ জুলাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সিদ্ধান্তে তার দল আওয়ামী লীগ ও সরেকারের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এর এক সপ্তাহ পর ১৬ জুলাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

দুই বিদেশি হত্যা, গ্রেনেড-বোমা হামলা
২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে ইতালির ত্রাণকর্মী তাবেলা সিজারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর কয়েকদিনের মাথায় রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি একইভাবে খুন হন। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস(ইসলামি স্টেট) এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে দাবি করে বার্তা দেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ’।  

এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে নানা চাপের মধ্যে পড়ে সরকার। প্রভাবশালী কিছু দেশ বাংলাদেশে তাদের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করে। বাংলাদেশ বিদেশিদের জন্য নিরাপদ নয় বলেও বলা শুরু করে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিল করে দেয়।

একই সময়ে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যাসহ আশুরার তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা এবং কয়েকটি গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটে। বিষয়গুলো সরকারের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। বেকায়দায় ফেলে দেওয়া এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

ব্লগার-প্রকাশক হত্যা
বছরজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ব্লগার, মুক্তমনা লেখক ও প্রকাশক হত্যাকাণ্ড। থেমে থেমে আকস্মিকভাবে চলা এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো কুল-কিনারা এখনও হয়নি। তবে হত্যার সঙ্গে যুক্ত এবং সন্দেহভাজন বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় জঙ্গিদের হাতে প্রকাশ্যে নিহত হন ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়। এ সময় তার স্ত্রী বন্যাও গুরুতর আহত হন। ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ১২ মে সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, ৭ আগস্ট খিলগাঁওয়ের বাসায় ঢুকে ব্লগার নিলয় নীল এবং ৩১ অক্টোবর প্রকাশক-লেখক ফয়সল আরেফিন দীপনকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একইদিন আরও একজন প্রকাশক ও দু’জন লেখক-ব্লগারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তারা প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হন।

সাকা-মুজাহিদ-কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর
দেশের দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা সরকারের বছরের আর একটি বড় সাফল্য। ২১ নভেম্বর রাতে এ রায় কার্যকর করা হয়। ফাঁসির আগের কিছু ঘটনার কারণে সরকারের জন্য এই রায় কার্যকর এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিলো। ফাঁসির পর দেশে সহিংসতা ও নাশকতার আশঙ্কা করেছিলো সরকার। আরও বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ঘটানোর পরিকল্পনার তথ্যও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিলো।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে বাড়তি সর্তকতা ও প্রস্তুতি নিতে হয়। নানা দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে শেষ পর্যন্ত অবশ্য নাশকতা এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

বিদায়ী বছরের ১১ এপ্রিল রাতে কার্যকর করা হয় আরেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি।

পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধন
১২ ডিসেম্বর বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে সরকার তার চ্যালেঞ্জের আরও এক ধাপ উত্তীর্ণ হয়েছে বিদায়ী বছরে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পদ্মাসেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে শুরু থেকেই জটিলতা তৈরি হয়। অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্বব্যাংক। এক পর্যায়ে সরকার বিশ্বব্যাংককে না করে দিয়ে নিজস্ব অর্থে পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়।

প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণে ৩ বছর সময় নির্ধারণ করেছে সরকার। ইতোমধ্যেই সেতুটির বিভিন্ন ধাপের কাজ মিলিয়ে ৩০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।

চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ
২৮ সেপ্টেম্বর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলাদেশ প্রায়ই খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। প্রকৃতির এসব বিরুদ্ধতার মুখে এ দেশের মানুষের টিকে থাকা ও ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি-সহিষ্ণুতা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রীর ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ সম্মাননা পাওয়ার মধ্য দিয়ে এই স্বীকৃতি অর্জন হয়েছে। পুরস্কার গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী নিজেই মন্তব্য করেন, ‘এ পুরস্কার বাংলাদেশের জনগণের অজেয় মনোভাব ও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বীকৃতি। আমি আমার জনগণের পক্ষে এ পুরস্কার গ্রহণ ও তাদেরকে উৎসর্গ করছি’।

২৭ সেপ্টেম্বর তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থার (আইটিইউ) ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ও গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর এ দু’টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তি বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় অর্জন।

দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন
বিদায়ী বছরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে এবং দলীয় প্রতীকে করার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ৩০ ডিসেম্বর এর প্রথম ধাপে পৌরসভা নির্বাচন আয়োজনে সফলতাও দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।  

গত ২২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে এ বিলটি পাস হয়। এখন থেকে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের উপজেলা, পৌরসভা, ও ইউনিয়ন পরিষদের মেয়র-চেয়ারম্যান প্রার্থীরা দলীয়ভাবে এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেবেন।

ফেসবুক বন্ধ
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার স্বার্থে কিছুদিনের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বন্ধ রাখা হয়। ২১ নভেম্বর যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি হয়। এর আগে ১৮ নভেম্বর থেকে ফেসবুক বন্ধ রাখে সরকার। একই সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভারসহ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর বড় কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা কঠোর সমালোচনা না হলেও মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেও চলে আসে। অবশেষে ১০ ডিসেম্বর ফেসবুক ও পরে অন্য মাধ্যমগুলো খুলে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৬
এসকে/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।