ঢাকা: মধ্যরাতে বাতাস বইছে উত্তরের। কুয়াশাঝরা কনকনে শীতে এগোতেই সন্ধান পাওয়া গেল তার।
তিনটি কুকুরের সঙ্গে ফুটপাতেই রাত্রিবাস। বছরের পর বছর এভাবেই রাত কাটছে তার। তবে দিনের বেলায় তার দেখা পাওয়া যায় না।
রাতে সন্ধান পাওয়ার পর তাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হলো। অনেক চেষ্টায় বের হয়ে এলো অজানা অনেক কথা। যেটুকু শুনে তার সন্ধান করা, পাওয়া গেল তার চেয়ে অনেক বেশি।
কম্বলের নিচে শুয়ে থাকা মানুষটি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত নায়েক সাদিকুর। তার বড় পরিচয়, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। লোকে ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ বললেও আসলে তিনি পুরোপুরি সুস্থ।
রাজধানীর ফার্মগেট থেকে কারওয়ানবাজার যেতে প্রথম ফুটওভার ব্রিজ। তার আগেই ফার্মগেট থেকে বাম পাশে (পুর্ব পাশ) ফুটপাতে হাঁটতেই একটি যাত্রীছাউনি। পরিত্যক্ত যাত্রীছাউনি বলাটাই মানানসই।
শুক্রবার (২৫ ডিসেম্বর) দিনগত মধ্যরাতে এ যাত্রীছাউনিতেই ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল সাদিকুরকে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন জানালেন, প্রতিরাতেই কম্বলের নিচে তিনটি কুকুর পাশে নিয়ে ঘুমান এই মুক্তিযোদ্ধা।
কম্বলের ভেতর থেকে সাদিকুর বের হওয়ার পর টমি ও হিটলারসহ কুকুর তিনটিও বেরিয়ে পড়ে কম্বলের নিচ থেকে। যদিও বার বার তাদের কম্বলের নিচে রাখার চেষ্টা করছিলেন তিনি।
সাদিকুর জানান, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে বেঙ্গল রেজিমেন্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে একাত্তরে যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৮১ সালে নায়েক হিসেবে অবসরে যান।
কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে বেশ খানিকটা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে দুই ভাষাতেই তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বললেন, ‘ছিলাম ন্যাশনাল টাইগার অব পাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীন দেশে ন্যাশনাল টাইগার হতে পারিনি। তাই এখন ডাস্টবিনে’।
দ্রুতগতিতে কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যান মুক্তিযোদ্ধা সাদিকুর। এবার উল্টো জানতে চান, ‘এসব বলে আমার লাভ কি? আমার কথাগুলো কি শেখ হাসিনার কানে যাবে? তোমরা লিখলেই কি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাতে পৌঁছাবে?’
বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে সহসাই আবার আলাপচারিতা শুরু করেন এই মুক্তিযোদ্ধা। বলেন, ‘আমার বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের শ্রীপুর এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধে ৫ নম্বর সেক্টরে ছিলাম। কমান্ডার ছিলেন মীর শওকত আলী’।
‘পঞ্চগড়ে যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। চারজনকে মেরে ফেলে রেখে ওরা চলে যায়। কিন্তু আমি মরিনি। অন্য তিনজন মারা যান। ওরা (পাকিস্তানি সেনা) মরে গেছি ভেবে আমাদের ফেলে রেখে চলে যায়। চার ঘণ্টা পর আমি বুঝলাম, মরিনি, বেঁচে আছি’।
সরকার কোনো সহায়তা করছে কি-না জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা সাদিকুর বলেন, ‘সরকার মাসে ৮ হাজার টাকা ভাতা দেয়। তা দিয়ে ছেলেকে ইন্টারমিডিয়েট পড়াচ্ছি’।
মুক্তিযোদ্ধা সাদিকুর বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার কথা পৌঁছে দিলে তাকে আর ফুটপাতে থাকতে হবে না। বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনা জানলে আমার একটা ঘর হবে’।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া ভাতা আর পেনশনের অর্থ দিয়ে কোনো রকমে চলে তার। তাহলে টোকাই আর দিনমজুরের কাতারে ফুটপাতে কুকুরের সঙ্গে রাত্রিবাস কেনো জানতে চাইলে বলেন- ‘ওরা আমার সঙ্গে বেইমানি করে না। আমি আগেও বিড়াল পালন করেছি। কাক পাখিদের খাইয়েছি। কেউ বেইমানি করেনি’।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ আবার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এই মুক্তিযোদ্ধা। নিজেকে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ লোক দাবি করেন। কয়েকজন ‘বিতর্কিত’ আওয়ামী লীগ নেতা আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন না, শুধু স্বার্থ খোঁজেন বলেও অভিযোগ তার। বললেন, ‘দেশের মানুষ খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে দেশের উন্নতি করছেন। আর ওই নেতারা শুধু টাকা কামিয়ে যাচ্ছেন’।
ঘর-সংসার আর আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহ দেখাননি এই মুক্তিযোদ্ধা। দিনে কুকুরগুলোকে কোথায় রাখেন, নিজে দিনের বেলায় কোথায় থাকেন তাও জানাতে চান না। শুধু বলেন, ‘আমি পীরের মুরিদ’।
ততোক্ষণে ঠাণ্ডা বাতাসে তার কথাগুলো আস্তে আস্তে জড়িয়ে গেছে। পীরের নাম বললেও তা বুঝে নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই মুক্তিযোদ্ধার কষ্টের সবগুলো কথা জানার চেষ্টা থাকলেও রহস্যই থেকে যায় বেশ খানিকটা।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৫
এসএমএ/এএসআর