ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আসল পোড়াবাড়ির মিষ্টি খেতে টাঙ্গাইল শহরে

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৪
আসল পোড়াবাড়ির মিষ্টি খেতে টাঙ্গাইল শহরে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

টাঙ্গাইল থেকে ফিরে: টাঙ্গাইল শহর থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে (৭ কি.মি দূরত্ব) পোড়াবাড়ি  গ্রাম। মিষ্টির রাজা চমচমের বিস্তৃতি এ পোড়াবাড়ি থেকেই।

তবে চমচমের তীর্থ পোড়াবাড়িতে এর জৌলুস ঠিক আগের মতো দেখা না গেলেও জমজমাট টাঙ্গাইল শহরে 'আসল পোড়াবাড়ির মিষ্টি'!

টাঙ্গাইল শহরের নিরালা মোড়ে পাঁচ আনি বাজারে মিষ্টির দোকানগুলো সারাদিনই থাকে লোকেলোকারণ্য। সারা দেশ থেকে চমচমের অর্ডার, ঘুরতে আসাদের কিনে নিয়ে যাওয়া, ভোজন রসিক ও স্থানীয়দের চাহিদা মিলে এখানে যে ১৫/২০টি মিষ্টির দোকান রয়েছে তার প্রতিটিতেই জমজমাট অবস্থা।

তবে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেলো, সুনামের দিক দিয়ে এ বাজারে আসল পোড়াবাড়ি তকমা পেয়েছে 'জয়কালী' মিষ্টান্নের দোকান। এছাড়াও এখানে খাঁটি চমচম বিক্রিতে সুনাম রয়েছে গোপালের দোকানেরও।

কথা হলো, জয়কালী মিষ্টান্ন দোকানের কর্ণধার স্বপন ঘোষের সঙ্গে।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় ৮০ বছর আগে আমার বাবা খোকা ঘোষ এই দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা ঐতিহ্যের ধারায় ব্যবসা করে চলেছি। পোড়াবাড়ি গ্রামে এখন আর তেমন চমচমের ঐতিহ্য নেই। বিভিন্ন কারণে তারা পিছিয়ে পড়েছে।

স্বপন ঘোষ বলেন, মূলত এখন টাঙ্গাইল শহরে পাঁচ আনি বাজারকে ঘিরে পরিচালিত হচ্ছে ঐতিহ্যের পোড়াবাড়ি খ্যাত চমচম ব্যবসা। পোড়াবাড়ি গ্রাম থেকে চমচম ব্যবসা এখন টাঙ্গাইল শহরে উঠে এসেছে। আর মানুষের হাতের নাগালে ঐতিহ্যমণ্ডিত চমচম তুলে দিতে পেরে আমরাও ধন্য।

স্বপন ঘোষ দীর্ষ ৪০ বছর ধরে চমচম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পোড়াবাড়ির আসল যে মিষ্টির স্বাদ ও মান ছিল তা ধরে রাখতে পেরেছি বলেই আমাদের এই জয়কালী মিষ্টান্নের দোকানটির সুমান মানুষের মুখে মুখে। অনেকেই পোড়াবাড়ি লিখে মিষ্টির দোকান দিয়ে বসেছেন ব্যবসা করতে, তবে তারা শুধুই ব্যবসার জন্য দোকান করেছেন। আর আমরা এখানে গুটি কয়েক দোকানি রয়েছি যারা সেই আদি ঐতিহ্য অনুসরণ করে চলেছি। আমাদের লক্ষ্য এখানে শুধুই ব্যবসা নয়, মানুষকে চমচম মিষ্টির আসল স্বাদ আস্বাদন। যে স্বাদে জিভে জল আসে। আর আসল পোড়াবাড়ির মিষ্টি খেতে টাঙ্গাইল শহরেই আসতে হবে ভোজন রসিকদের।

বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে শীতকালে চমচমের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে এমনটা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন আমার দোকানে চমচম বিক্রি হয় ৪৫ থেকে ৫০ কেজির মতো। তবে শীতের দুই মাস তা বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সে সময়কে মিষ্টি তথা চমচমের সিজনও বলা হয়।

তিনি বাংলানিউজকে জানান, শুধু চমচমই নয়; রসগোল্লা, ছানা ইমিরতি, পানতুয়া, সন্দেশ, দই, রসমালাইও বিক্রি করেন তিনি। আর দাম হিসেবে উল্লেখ করেন,  চমচম- ২০০। রসগোল্লা- ২০০, ছানা ইমিরতি- ২০০, পানতুয়া- ২০০, সন্দেশ- ৫০০, দই- ২০০ এবং রসমালাই- ৩০০ টাকা কেজি।

বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় খানিক পাশের দোকান, গোপাল মিষ্টান্নের মালিকের সঙ্গে। নিজেদের নামে প্রতিষ্ঠিত এই দোকানের মালিক গোপাল বাবু জানান, সুনাম ধরে রেখে ব্যবসা করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। টাঙ্গাইল শহরের এই বাজারে যতগুলো মিষ্টির দোকান রয়েছে তার মধ্যে গোপালের দোকান বললেই সবাই চেনে। আমাদেরসহ এখানে আরো দুই/একটি দোকান রয়েছে যারা আদি চমচম বিক্রেতা। আর তারাই মূলত বর্তমানে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির মিষ্টির মূল ধারক-বাহক।

গোপালের চমচম ছাড়াও গোপালের খাঁটি ঘি-এর কদর অত্যাধিক বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে, স্বপন ঘোষের জয়কালী মিষ্টান্ন দোকানে পাশেই রয়েছে সুবিশাল মিষ্টি বানানোর কারখানা। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য মিষ্টি তৈরির সময় তিনি সে কারখানা ঘুরে দেখান।

জানা যায়, সেখানে কাজ হয় তিন শিফটে। সকালে কাজ করেন ৩ জন। বিকেলে ১২ জন। আর সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থাকেন আরো ২ জন।

এ দোকানে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ মণ দুধ সংগ্রহ করা হয়। স্বপন ঘোষ জানান, প্রতি রাতে ওই পরিমাণ দুধ চুলায় জ্বাল দিয়ে প্রায় ১০০ কেজি ছানা তৈরি করা হয়। যা দিয়ে ৩০০ কেজি মিষ্টি পাওয়া যায়।

সেই সঙ্গে আরো ৭/৮ কেজি দুধ লাগে মাওয়া তৈরিতে। মাওয়াকে এখানকার স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ক্ষীর। ওই পরিমাণ দুধকে অতিরিক্ত চুলায় জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে মাওয়া তৈরি করা হয়।

মিষ্টি তৈরির প্রণালী হিসেবে জানা যায়, প্রথমে ২০/২৫ মণ দুধের ১০০ কেজি ছানাকে গোল করে মিষ্টির আকার দেওয়া হয়। এরপর গঠন শক্ত করতে কিছু সময় রেখে কড়া চিনির সিরায় ঢেলে ওই মিষ্টি আকৃতির ছানাগুলো ভাজা হয়। প্রায় ৪৫ মিনিট ফুটন্ত সিরায় তা ভেজে; ঠাণ্ডা করা হয় এবং তা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে মাওয়ার মধ্যে গড়িয়ে বিক্রির জন্য পরিবেশন করা হয়।

স্বপন ঘোষের এ কাখানায় কাজ করেন, প্রতিপ ঘোষ, হরিলাল, রতন ঘোষ, মহাদেব ঘোষ, হরিলাল ঘোষ, সাধন ঘোষ প্রমুখ। আর তিন শিফটের মধ্যে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত দুধ জ্বাল দিয়ে ছানা তৈরি করেন তিনজন। ছানা করার পাশাপাশি তারা সিরা ও দুধ জ্বাল দিয়ে মাওয়া তৈরি করে রাখেন।

এরপর বিকেলের শিফটে ৩টা থেকে আরো ১০/১১ জন তৈরি ছানা সিরায় ভাজেন। আর সার্বক্ষণিক বাকি দুইজন মিষ্টিতে মাওয়া লাগান।

ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জাদু সম্রাট পিসি সরকার, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী টাঙ্গাইলের চমচম এতোটাই পছন্দ করতেন যে তারা শুধুই মিষ্টি খেয়েই এক বেলা পার করে দিতেন। এছাড়া জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, নবাব আলী চৌধুরী, প্রিন্সিপাল ইব্রহিম খাঁ, প্রমথ নাথ চৌধুরীসহ অনেক ব্যক্তিত্বের পদচারণায় পোড়াবাড়ি ধন্য হয়। ধন্য হয় এই সুস্বাদু জিভে জল আনা চমচমও। আর তাই তো বর্তমান সময়ের এই শীত-শীত আবহে টাঙ্গাইল ঘুরে এ বিখ্যাত চমচমের স্বাদ আস্বাদন কার না কাম্য হয় আবার!

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।