ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বছরজুরে খুন, অপহরণ, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের ছড়াছড়ি

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০

ঢাকা : বছরজুড়ে সারাদেশে ছিল খুন-খারাবির তাণ্ডব। ছিল হরেক অপরাধের লাগামহীন দৌরাত্য।

ডাবল মার্ডার, ট্রিপল মার্ডার, পরিকল্পিত খুন, খুনের পর লাশ গুম, অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার, অপহরণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, দ্বিমুখী-ত্রিমুখী সংঘর্ষ, রগকাটা, হাত-পা কেটে দেওয়া, চোখ উপড়ে ফেলার মতো অসংখ্য লোমহর্ষক ঘটনার খবরে ঠাসা ছিল গণমাধ্যমগুলো। এতোসব নৃশংসতার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে ঘটেছে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার ঘটনা।

খুন-খারাবি সংঘটনের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১০ সালের প্রথম নয় মাস রাজধানী জুড়ে ঘটতে থাকা অপ্রতিরোধ্য ছিনতাই-রাহাজানির কারণে রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মানুষজন।

বছর জুড়ে ছিল ভূয়া র‌্যাব, ভূয়া ডিবি, ভূয়া পুলিশ পরিচয় দিয়ে বড় বড় অপরাধ সংঘটনের ছড়াছড়ি। বিশেষ করে সাদা পোশাকে র‌্যাব-গোয়েন্দা পরিচয় দিয়ে মানুষ অপহরণ ও গুম করার ঘটনা ঘটে আশংকাজনক হারে।

খোদ রাজধানীতে গুলি করে হত্যা করা হয় বংশাল থানার অপারেশন অফিসার গৌতম চন্দ্রকে। নয়াটোলা ফাঁড়ির আরেক পুলিশ কর্মকর্তা নৃশংস খুনের শিকার হন অজ্ঞান পার্টির হাতে। পাবনার দুর্গম চরে আসামি ধরতে গিয়ে চরমপন্থীদের ব্রাশফায়ারে একইস্থানে নিহত হন তিন পুলিশ সদস্য।

আবার আইন-শৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে, ক্রসফায়ারে এবং অন্যান্য পন্থায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে দেড় শতাধিক। আরও প্রায় ২শ’ মৃতদেহ পাওয়া গেছে যেসব হত্যার কুল-কিনারা হয়নি। এমনকি তাদের পরিচয় পর্যন্ত বের করতে পারেনি পুলিশ।

নৃশংসতার ছড়াছড়ি

সম্পত্তির লোভে ৩০ সেপ্টেম্বর ভোরে যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কের ৩৭/১ নম্বর চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় নিজ বাড়িতে মা-ছেলে ও পুত্রবধূকে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা।

২৫ সেপ্টেম্বর মিরপুরে মিজানুর রহমান নামে এক জুয়েলারি ব্যবসায়িকে অপহরণের পর ছুরিকাঘাতে হত্যার পর ট্রাভেল ব্যাগে ভরে লাশ ফেলা হয় মিরপুরের এক ড্রেনে। একইদিন ডেমরার ডগাইরে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয় অজ্ঞাত এক ব্যক্তিকে। ৭ অক্টোবর রাতে তুরাগে এক যুবককে জবাই করা হয়। একইদিন মগবাজারে ছাত্রলীগের হাতে যুবলীগ কর্মী শাহ আলম ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে খুন হন ইউসুফ।

মোহাম্মদপুর থানার ঢাকা উদ্যানের অদূরে তুরাগ বালুচর খুঁড়ে পাওয়া যায় তিন ব্যক্তির মৃতদেহ। তাদেরকে ২/৩ দিন আগেই অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ নদী তীরের বালুর নিচে চাপা দিয়ে রাখে। শেয়াল-কুকুর সে মৃতদেহ টেনে বের করায় তা লোকজনের নজরে আসে। কদমতলী থানায় সৎ ছেলে ও তার বন্ধুদের হাতে নৃশংস হত্যার শিকার হন নাবালিকা কন্যসহ মা। ৩০ নভেম্বর একই থানার রায়েরবাগ মেরাজনগরে নেশাসক্ত ছেলে তার মাকে জবাই করে খুন করে।

আবাসিক হোটেল যেন খুনের আস্তানা:

রাজধানীর আবাসিক হোটেগুলোতে সারা বছরই চলেছে খুন-খারাবি। সর্বশেষ ২৭ ডিসেম্বর রাতে দক্ষিণখান থানার আশকোনার শুভ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল কক্ষে একজন পুলিশ কনস্টেবলসহ দুইব্যক্তি নৃশংস খুনের শিকার হয়েছেন। এর আগে ২০ আগস্ট বনানীর লর্ডস ইন আবাসিক হোটেলের ৫ তলার এক নির্জন কক্ষে আটকে যৌণ ব্যবসায় রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে তরুনি সোমা আক্তার ওরফে স্বর্ণরুপাকে (১৯) নির্মম হত্যার ঘটনায় বিবেকবান মানুষেরা হতবাক হয়ে পড়েন।
ফকিরাপুল, বনানী-গুলশান, যাত্রাবাড়ী ও দারুসসালাম থানা এলাকার আবাসিক হোটেলগুলো থেকে এবছর ২০টিরও বেশি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। রাজধানীর বাইরে সিলেট ও চট্টগ্রামের আবাসিক হোটেলেও একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

চালক খুন : গাড়ি ছিনতাই

চালককে খুন করে গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনা এ বছর আশংকাজনক হারে বেড়েছে। সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৭ জন চালককে নৃশংসভাবে খুন করে গাড়ি ছিনতাই করে। শুধু গাড়ি ছিনতাইয়ের কাজটি নির্বিঘেœ সমাধা করার জন্যই চালকদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা দিশেহারা হয়ে পড়েন।

গাড়ি ছিনতাই প্রতিরোধ টিমের প্রধান ঢাকা মহানগর ডিবি’র সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মোখলেছুর রহমান জানান, ২০১০ সালে গাড়ি চুরি বিরোধী পুলিশি অভিযানও চালানো হয় সর্বাধিক। এসব অভিযানে সবচেয়ে বেশি গাড়ি উদ্ধার ও সর্বাধিক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করারও দাবি করেন তিনি। কিন্তু এরপরও থামেনি গাড়ি চুরি, বন্ধ হয়নি চালক হত্যার ধারাবাহিকতা।

নিছক সন্দেহেও গণপিটুনির নির্মমতা !

৯ ও ১০ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত আট ব্যক্তি সাধারণ মানুষের আক্রোশে প্রাণ হারান। ১০ অক্টোবর খুলনায় গণপিটুনিতে নিহত হন দুজন। পাইকগাছা উপজেলার পুতলাখালী গ্রামের চিংড়িপোনা ব্যবসায়ি দুলাল মণ্ডলকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে পালানোর সময় গণপিটুনিতে নিহত হয় দুই সন্ত্রাসী।

৯ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাউজানে গণপিটুনিতে মোহাম্মদ এস্কান্দার (৩৫) নামের এক যুবলীগ কর্মী নিহত হন। গুজরা ইউনিয়নের মগদাই বাজারে চাঁদাবাজির সময় গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। একইদিন নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়া কালিগঞ্জ বাজারে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী এক যুবক নিহত হন।

অপহরণ-নিখোঁজ-গুম

পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সূত্র অনুযায়ী এ বছর ১৭ ব্যক্তি নিখোঁজ বা গুম হয়েছেন। এসব ব্যাপারে আইন-শৃংখলা বাহিনীর প থেকে  গ্রহণযোগ্য কোনো বক্তব্যও দেওয়া হয়নি বলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।

১৯ মার্চ ঠাকুরগাঁও থেকে র‌্যাবের নাম করে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কাঠ ব্যবসায়ি আকবরকে। তার ভাই আইয়ুব আলী এ বিষয়ে মামলা করলে তাকে একজন সঙ্গীসহ ১৭ মে রাজধানীর খিলগাঁও থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ তিনজনের কেউ আজ পর্যন্ত আর ফিরে আসেননি। রাজধানীর পল্লবী থেকে ১৪ মার্চ দুই ভাই লালবাবু ও জালালকে র‌্যাবের নাম করে তাদের পরিবার পরিজনের সামনে থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। তারাও আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। এভাবে ফিরতে পারেননি রামপুরার টিটু, হাতিরপুলের জহির রায়হান হিরণ, গাজীপুরের হাসান, খিলগাঁওয়ের রনি, কাপাসিয়ার সেলিম, টিপিাড়ার রাকিবসহ অন্তত ১৭ ব্যক্তি।

বাংলাদেশ সময় : ১২৩০ ঘন্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।