ঢাকা, শুক্রবার, ১১ আশ্বিন ১৪৩২, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৭

জাতীয়

পথে পথে পুলিশ, নেতাকর্মী ও শ্রমিক সংগঠনের চক্র

তিন টনি ট্রাকে গড়ে তিন হাজার টাকা চাঁদা আদায়

শরীফ শাওন, সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ১২:৪১, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫
তিন টনি ট্রাকে গড়ে তিন হাজার টাকা চাঁদা আদায়

‘নওগাঁ থেকে বেগুন নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পৌঁছে দিয়েছি। পথে ৯ জায়গায় চাঁদা দিতে হয়েছে।

বুধবার রাতে তিন টনের একটি ট্রাকে পণ্য নিয়ে কারওয়ান বাজার পৌঁছে দিতে মোট চাঁদা দিতে হয়েছে দুই হাজার ৭৫০ টাকা। হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার নাম ভাঙিয়ে এবং বিভিন্ন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে এসব চাঁদা দিতে হয়েছে। ’

পণ্য পরিবহনে পথে পথে চাঁদাবাজির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে এমন বর্ণনা দিয়েছেন ট্রাকচালক রুহুল আমিন। তিনি বলেন, ‘নওগাঁ থেকে মালপত্র ট্রাকে লোড করার পর যাত্রার শুরুতে স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার নামে তাঁর কর্মীদের ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এরপর রওনা দিলে বাইপাস বটতলা এলাকা, নাটোর রেলগেট, বনপাড়া, যমুনা সেতুর আগে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় হাইওয়ে পুলিশদের ২০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়েছে। কয় স্থানে মোট চাঁদা দিতে হয়েছে এক হাজার ৮০০ টাকা।

ঢাকায় প্রবেশের পর আবদুল্লাহপুরে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীর পরিচয়ে আদায় করা হয়েছে ২৫০ টাকা চাঁদা। মহাখালীতে ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয়েছে ১০০ টাকা। এরপর কারওয়ান বাজারেও রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে আদায় করা হয়েছে ১০০ টাকা। ’

দেশের বিভিন্ন এলাকার আটজন কাঁচামাল ব্যবসায়ী, কৃষক, আড়তদার ও ট্রাকচালকের সঙ্গে কথা বলে পণ্য পরিবহনে পথে পথে চাঁদাবাজির এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

তাঁদের ভাষ্য মতে, ৫ আগস্টের পর পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি সাময়িকভাবে কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়েছিল। তবে বর্তমানে আবার হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের যন্ত্রণা আগের মতো শুরু হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে, আবার কোথাও কোথাও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে আবারও চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। বর্তমানে শাক-সবজি ও ফলের ট্রাকগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীর বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে দুই হাজার ৫০০ টাকা থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে।

মাগুরা থেকে শসাভর্তি ট্রাক নিয়ে একই দিন (গত বুধবার) কারওয়ান বাজারে পৌঁছে দিয়েছেন ট্রাকচালক মো. ইকবাল।

চাঁদার প্রসঙ্গ তুললেই তিনি বলেন, ‘মাগুরার ভায়না মোড় থেকেই মূলত টাকা ‘কালেকশন’ শুরু হয়। মাল ট্রাকে লোড করতেই রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে আদায় করা হয় ২০০ টাকা। এরপর আড়পাড়া, শালিকা ও শ্রীপুর থানার লাঙলবাঁধ এলাকা পার হতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে সব মিলিয়ে ৭০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এরপর কানাইপুর হাইওয়ে পুলিশকে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা দিতে হয়। যদি পদ্মা সেতু হয়ে যাই, তবে ভাঙা হাইওয়েতে পুলিশকে একই পরিমাণ টাকা দিতে হয়। এরপর মাওয়া হাইওয়ে পুলিশ, যাত্রাবাড়ী যাওয়ার পর হাসনাবাদ ও যাত্রাবাড়ী ব্রিজের নিচে ট্রাফিক পুলিশ, ফার্মগেটের সংসদ ভবনের মাথায়, শ্যামলী ও গাবতলীতেও ট্রাফিক পুলিশকে টাকা দিতে হয়। গাড়ি দাঁড় করালেই চা-পানির নামে ১০০ টাকা আদায় করে। যদি যমুনা সেতু দিয়ে না এসে ঘাট পার হয়ে যাই, তাহলে গোয়ালন্দ, গোলারা এবং মানিকগঞ্জ থেকে সাভার পর্যন্ত অন্তত তিন স্থানে পুলিশের চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়। ’

কুষ্টিয়া থেকে রাজধানীতে ফল নিয়ে আসা ট্রাকচালক মো. বাদশা বলেন, ‘কুষ্টিয়া হাইওয়ে, রাজবাড়ীর পাংশা হাইওয়ে ও গোয়ালন্দে আহলাদীপুর হাইওয়ে পুলিশ খুব বেশি অত্যাচার করে। বাড়তি মাল নেওয়ার অজুহাতে, আবার কখনো সব ঠিক থাকলেও মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা নেয়। ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে দিতে হয়। এরপর আরিচা হাইওয়ে, মানিকগঞ্জ, বেড়িবাঁধ বিশেষ করে হাজারীবাগসহ আশপাশের কয়েকটি জায়গায় পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। ’

বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাই বলেন, ‘বর্তমানে মেহেরপুর থেকে কারওয়ান বাজারে তিন টনের একটি ট্রাকে পণ্য পাঠাতে খচর পড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা। এই আকারের একটি ট্রাক থেকে ন্যূনতম তিন হাজার টাকা করে চাঁদাবাজি করা হয়। রাস্তায় চাঁদাবাজির কারণে আমাদের ট্রাকভাড়া বেড়ে যায়। চালক রাস্তায় যে টাকা চাঁদা হিসেবে দেন, তা হিসাব করে ট্রাক মালিককে ওই টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ কারণে একজন ব্যবসায়ী তাঁর পণ্য গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চাইলে ট্রাক মালিক রাস্তার বাড়তি খরচ হিসাব করে ভাড়া নির্ধারণ করেন। ’

তিনি আরো বলেন, ‘রাস্তায় চাঁদাবাজির জন্য ট্রাক মালিক এবং পুলিশ উভয়েই দায়ী। কারণ একজন ট্রাক মালিক বাড়তি টাকার লোভে তাঁর গাড়ির ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ মাল তুলে দেন। এ অবস্থায় পুলিশ মামলা দিতে চাইলে চালক নগদ অর্থ দিয়ে বিষয়টি রফা করেন। এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগেও ঘাটতি আছে। সরকার বারবার দেশের বিভিন্ন স্থানে ওজন মাপক যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে অনৈতিক লেনদেনের পাশাপাশি সড়কের ক্ষয়ক্ষতি এবং কখনো কখনো মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। ’

বরিশালের মুলাদী উপজেলার সবজি ব্যবসায়ী বাবুল হায়দার বলেন, ‘আমি মূলত রাজধানীর বিভিন্ন আড়তে শিম সরবরাহ করি। এ ছাড়া অন্যান্য সবজিও দিয়ে থাকি। গত বুধবার ১০০ ট্রাক শিম রাজধানীতে পাঠিয়েছি। ট্রাকপ্রতি তিন হাজার টাকা করে চাঁদা পরিশোধ করতে গিয়ে এক দিনেই আমাকে তিন লাখ টাকা চাঁদা গুনতে হয়েছে। ’

এনডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।