ঢাকা, রবিবার, ১ আষাঢ় ১৪৩২, ১৫ জুন ২০২৫, ১৮ জিলহজ ১৪৪৬

জাতীয়

পাহাড়ে ট্যুর অপারেশনে দায়িত্বহীনতা, পদে পদে মৃত্যুফাঁদ

আনিসুর বুলবুল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:১১, জুন ১৫, ২০২৫
পাহাড়ে ট্যুর অপারেশনে দায়িত্বহীনতা, পদে পদে মৃত্যুফাঁদ

পাহাড় ডাকছে। ঝর্ণা ডাকছে।

সবুজে মোড়ানো স্নিগ্ধ প্রকৃতি যেন হাতছানি দিয়ে বলছে—‘চলো ঘুরে আসি’। আর এই হাতছানির সুযোগ নিয়েই অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে একের পর এক মনকাড়া পোস্ট, চোখধাঁধানো ভিডিও, উসকানিমূলক ক্যাপশন।

উদ্দেশ্য একটাই—আপনাকে যেকোনোভাবে ভ্রমণে টেনে আনা। অথচ এই ট্যুর অপারেটরদের অনেকেই জানেন না বা মানেন না পাহাড়ের প্রকৃত আচরণ, মরসুমি বৈরিতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুত্ব কিংবা বিপদের সম্ভাব্যতা। অনভিজ্ঞ, অদক্ষ এবং লোভনীয় বিজ্ঞাপন নির্ভর এইসব অপারেটরদের কারণে প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। দুর্গম পাহাড় আর ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেইলে বেড়াতে গিয়ে ফেরা হচ্ছে না অনেকের।

সম্প্রতি বান্দরবানের শামুকঝিরি ঝরনার কাছে পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছেন দুই পর্যটক, তার মতো আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন বা প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন অল্পের জন্য। ঘটনা তদন্তে দেখা যায়, এই দলে কোনো স্থানীয় গাইড ছিল না, ছিল না পর্যাপ্ত প্রস্তুতি বা জরুরি পরিকল্পনা। বর্ষাকালে যখন পাহাড়ি ঝরনা গর্জে ওঠে, তখনও ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছিল—একটি পরিণতির কথা জেনেও যাকে বলা যায় ‘পরিকল্পিত অবহেলা’।

অথচ আইনের চোখে এসব স্পষ্ট অপরাধ।

বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটর (নিবন্ধন ও পরিচালন) বিধিমালা, ২০২৪ অনুযায়ী, প্রতারণা, মিথ্যা তথ্য প্রদান, নিরাপত্তা অবহেলা, নিবন্ধনবিহীন সেবা, শিশু শ্রম বা প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি—সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? ১০ জনের ভ্রমণ অনুমতি নিয়ে নেওয়া হচ্ছে ৩০ জনকে, একজন গাইড দিয়ে সামলাতে হচ্ছে পুরো দল, অনেক সময় সেই গাইডও থাকে কাগজে-কলমেই। পর্যটকের নাম-ঠিকানা লুকিয়ে প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে যে রকম ইচ্ছা সেরকম ‘অ্যাডভেঞ্চার’ করানো হচ্ছে। এটি আর নিছক অব্যবস্থাপনা নয়—এ এক নির্মম প্রতারণা, যার মূল্য দিতে হচ্ছে প্রাণ দিয়ে।
ট্যুর অপারেশন একটি দায়িত্বপূর্ণ পেশা।

এটি শুধু কাউকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার বিষয় নয়, এটি নিরাপদে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার। আপনি যদি কারো ভ্রমণের আয়োজক হন, তবে তার প্রতিটি মুহূর্তের নিরাপত্তা ও সেবা আপনারই দায়িত্ব। কিন্তু এখন অনলাইন জনপ্রিয়তা, ইনফ্লুয়েন্সার চেহারা বা ইউটিউব ভিউয়ের লোভে বহুজন এই দায়িত্বকে ঠাট্টায় পরিণত করেছে। যার ফলাফল ভয়াবহ—পরিবার হারাচ্ছে সন্তান, বন্ধু হারাচ্ছে বন্ধু, দেশ হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় নাগরিক।

এই অবস্থার অবসান জরুরি। এখনই সময় কঠোর অবস্থান নেওয়ার। অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে অবৈধ, অদক্ষ ও নিবন্ধনবিহীন ট্যুর অপারেশন। প্রত্যেক পর্যটন সংক্রান্ত আয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণের পূর্বে আবহাওয়া, নিরাপত্তা ও গাইড নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। যারা এই নিয়ম মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করাই এখন সময়ের দাবি।

আর সাধারণ মানুষকেও হতে হবে সচেতন। টিকটক কিংবা ফেসবুকে দেখানো সুন্দর দৃশ্যের পেছনের বাস্তবতা ভয়ংকর হতে পারে। পাহাড়ি সৌন্দর্য অবশ্যই উপভোগ করুন, কিন্তু চোখ বুজে বিশ্বাস করবেন না যেকোনো ট্যুর অপারেটরকে। যাচাই করুন তাদের অভিজ্ঞতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, লাইসেন্স ও অনুমোদন। মনে রাখবেন—ভ্রমণ বিলাসিতা হতে পারে, কিন্তু তা যেন মৃত্যুর কারণ না হয়।

প্রকৃতি আমাদের ভালোবাসুক, শাস্তি না দিক। এজন্য চাই দায়িত্বশীল ভ্রমণ, নিরাপদ পরিকল্পনা এবং সর্বাগ্রে চাই সচেতনতা। প্রশাসনের পাশাপাশি আমাদেরও জেগে উঠতে হবে, নয়তো দুর্ঘটনার এই মিছিল থামবে না। পাহাড়ের সৌন্দর্য আমরা চাই, তবে তা যেন কারো জীবনের শেষ দৃশ্য না হয়।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।