ঢাকা, সোমবার, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

ফরায়েজী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ দুদু মিয়ার ১৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

ফয়সাল আকবর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬:৪৬, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১২
ফরায়েজী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ দুদু মিয়ার ১৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

ঢাকা: ঐতিহাসিক ফরায়েজী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের দোসর বশংবদ জমিদার-নীলকরদের আতংক পীর মুহসীন উদ্দীন আহমদ দুদু মিয়ার ১৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ২৪ সেপ্টেম্বর।

ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পথ নির্দেশনা দানকারী ঐতিহাসিক ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তুল্লাহর সুযোগ্য পুত্র পীর মুহসীনউদ্দীন দুদু মিয়া ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নিপীড়িত জনগণের আত্মশক্তির বিকাশ এবং ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাসে দুদু মিয়া ছিলেন এক অন্যতম মহানায়ক।
 
দুদু মিয়া প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তার যোগ্য পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহর কাছে। মাত্র ১২ বছর বয়সে তাকে মক্কায় পাঠানো হয় জ্ঞানার্জনের জন্য। কলকাতা হয়ে মক্কা যাওয়ার সময় তিনি বারাসাতে বাংলার আরেক মহান বীর তিতুমীরের সঙ্গেও দেখা করেন বলেও ঐতিহাসিক সূত্রগুলোতে উল্লেখ রয়েছে।  

মক্কায় তিনি পাঁচ বছর গভীর অধ্যয়নে ব্যয় করেন। মক্কা থেকে বাড়ি ফিরে আসেন ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহর ইন্তেকালের পর ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

দুদু মিয়ার অধীনে বাংলা ও আসামের নিপীড়িত জনগণ শক্তিশালী ভ্রাতৃত্ববোধে একতাবদ্ধ হয় ব্রিটিশদের বশংবদ অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কোনরকম বিদ্রোহ ঘোষণা ছাড়াই দুদু মিয়া বাংলা ও আসামের নিপীড়িত জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সম্পূর্ণ বিকল্প এক আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তখনকার জমিদাররা তাদের প্রভু ইংরেজদের তুষ্ট করে প্রজাদের ওপর নানা নিপীড়ণমূলক কর আরোপ করে। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে জনগণ এসব নিপীড়ণমূলক কর দিতে অস্বীকার করে।

ঢাকা অঞ্চলে যখন ফরায়েজী আন্দোলন সংখ্যায় ও শক্তিতে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন জমিদার ও নীলকররা ফরায়েজী আন্দোলনকে স্তিমিত করতে নানা অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে।

ফরায়েজী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে রায়তদের আটক ও প্রহার করা ছাড়াও খুঁটির সঙ্গে দাড়ি বেঁধে নাকে মরিচের গুড়ো ঢুকিয়ে দেয়া হতো। তাদের মাটিতে ফেলে জোর করে ধরে রেখে তাদের নাভির উপর বিষাক্ত ও ভয়ংকর পোকা ছেড়ে দেয়া হতো। জমিদাররা দাড়ি রাখার ওপর দাড়িকর ছাড়াও আরও প্রায় ৩০ রকমের অবৈধ কর আরোপ করে। কর দিতে অস্বীকারকারীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।

শরীয়তুল্লাহর ইন্তেকালের পর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে জনগণ আরও ব্যাপকভাবে সংগঠিত হয় এই অত্যাচার-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে।

১৮৩৮ সালে মক্কা থেকে ফেরার মাত্র এক বছর পর দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে পরগৃহ লুণ্ঠনের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগকারী ছিল জমিদার, নীলকর এবং তাদের মিত্র সরকারি পুলিশ বাহিনী। এদের মুখপাত্র ছিল নীলকর ডানলপ।

কিন্তু তাদের অন্যায় অভিযোগ ফসকে যায়, মুক্তি পান দুদু মিয়া। ১৮৪১ সালে চুচরী নামক এক ব্যক্তিকে খুনের দায়ে দুদু মিয়া ও তার আরও কয়েকজন শিষ্যকে অভিযুক্ত করা হয়।

ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজের বিচারে দুদু মিয়া মুক্তি পান, কিন্তু তার ২২ শিষ্যকে সাত বছর করে কারাদ- দেওয়া হয়।

১৮৪১ সালে কানাইপুর, ১৮৪২ সালে ফরিদপুরে অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে দুদু মিয়ার অনুসারীদের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। নীলকর-জমিদারদের পুঞ্জীভূত আক্রোশ দুদু মিয়া অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবেলা করেন।

তার বিরুদ্ধে এ সময় তৈরি করা হয় নানা কাল্পনিক অভিযোগ। ১৮৪৬ সালে (বাংলা ১২৫৩ সালের ৩০ ভাদ্র) ডানলপের গোমস্তা, জমিদার গঙ্গাপ্রসাদ চৌধুরী, পাঁচচরের গোপীমোহন বাবু ও জগৎ চন্দ্র বাবুর নেতৃত্বে লাঠিয়াল বাহিনী দুদু মিয়ার বাহাদুরপুরের বাড়ি আক্রমণ করে।   এসময় তার বেশ কয়েকজন অনুসারীকে হতাহত করে বাড়ির মুল্যবান গৃহসামগ্রী লুণ্ঠন করে তারা।

প্রতিকার চেয়ে আদালতের দারস্থ হন দুদু মিয়া, কিন্তু স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষের কারসাজিতে ফেঁসে যায় মামলাটি। কিন্তু এই অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর হন দুদু মিয়া। কিছু দিনের মধ্যেই কাদির বখশের নেতৃত্বে ডানলপের নীলকুঠি আক্রমণ করে দুদু মিয়ার অনুসারীরা।

ডানলপ পালিয়ে যায়। ধরা পড়ে তার গোমস্তা কাঞ্জীলাল। আদালতে অভিযোগ আনা হয় দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। দুদু মিয়া ও তার কিছু সংখ্যক হিন্দু ও দেশীয় খৃষ্টান অনুচরসহ মোট ৪৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

ওই মোকদ্দমায় দুদু মিয়া ও তার সব অনুচর বেকসুর খালাস পান। এর পর থেকে দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের প্রভাব প্রতিপত্তি বহুগুণে বেড়ে যায়।

জমিদার-নীলকররা নানা কূট-কৌশলের আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলেও তারা ব্যর্থ হয়। দীর্ঘ এক দশক দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে তারা আর দাঁড়াতে পারেনি।

তবে ১৮৫৭ সালে আবারও বন্দীত্ব বরণ করতে হয় এই মহান স্বাধীনতা-সংগ্রামীকে। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে তখন সিপাহী বিদ্রোহের ডামাডোল। জমিদার ও নীলকররা এ সময় সরকারের কান ভারি করে তোল দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

তখন সরকার ছিল নাজুক অবস্থায়। ফলে গ্রেফতার করা হয় দুদু মিয়াকে। পরে ১৮৫৯ সালে মুক্তি পেলেও অসৎ জমিদারদের উস্কানিতে আবারও বন্দী হন তিনি।

তার বিরুদ্ধে কোন মামলা না থাকলেও ১৮৬০ সাল পর্যন্ত বন্দি রাখা হয় তাকে। তিনি যখন কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন তার স্বাস্থ্য ভগ্নপ্রায়। মুক্তির অল্পকাল পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

এর পর তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এখানেই ইন্তেকাল করেন তিনি। পুরান ঢাকার ১৩৭ নং বংশাল রোডে কবর দেয়া হয় তাকে। এখানেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী।

কর্মসূচি
পীর দুদু মিয়ার ১৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সোমবার বিকাল ৪টায় ‘ফরায়েজী আন্দোলন: এক বহুমাত্রিক মুক্তিসংগ্রাম’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ, ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর, সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান , সাবেক সচিব আসাফউদ্দৌলাহ, পীর মুঈন উদ্দিন আহমদ, ড. কে.এম মহসীন, ড. মাহবুব উল্লাহ, কবি আবদুল হাই শিকদার, ড. আহসান উল্লাহ ফয়সাল, ড. মাহফুজ পারভেজ ও লেখক-গবেষক ফাহমিদ-উর-রহমান প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়:০৬২৯ ঘণ্টা,সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১২
সম্পাদনা:রাইসুল ইসলাম,নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।