ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

হামিদ ভাই: বর্ণাঢ্য এক ক্রীড়াব্যক্তিত্ব

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১২
হামিদ ভাই: বর্ণাঢ্য এক ক্রীড়াব্যক্তিত্ব

ঢাকা: ‘হামিদ ভাই’। ছোট-বড় সবার কাছে এক নামে পরিচিত।

সেই ধারা ভাষ্যকার আবদুল হামিদের কণ্ঠে আর শোনা যাবে না সম্মোহনী ধারাভাষ্য। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকার পর শনিবার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ৭৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী আবদুল হামিদ এক সময় খেলেছেন, খেলা পরিচালনা করেছেন। হয়েছেন ক্রীড়া সংগঠক, ক্রীড়া সাংবাদিক। সব ছাপিয়ে জনপ্রিয় ছিলেন ক্রীড়াভাষ্যকার হিসেবে।

১৯৩৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ভারতের নদীয়ায় জন্ম আব্দুল হামিদের। ১৯৪৮-৪৯ সালে বর্ধমান টাউন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে থাকাকালে আবদুল হামিদকে খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন এঁকে দেন স্কুলের গেম টিচার সুচাঁন্দ বাবু। ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস, ক্রিকেট খেলতেন তিনি।

দেশভাগের পর আবদুল হামিদের পরিবার ঢাকায় চলে আসে, ঠাঁই হয় গেন্ডারিয়ায়। ১৯৫১ সালে গেন্ডারিয়া স্কুলে ভর্তি হন নবম শ্রেণীতে। সে সময় খেলাধুলায় গেন্ডারিয়া স্কুলের বেশ সুনাম ছিল।

১৯৫৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। জগন্নাথ কলেজ তখন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে খেলতো। সেই দলের খেলোয়াড় ইকবাল, সুকুমার, খোদা বক্স, মুক্তা, আবদুল খালেক, বাদশার সঙ্গে হামিদও ছিলেন। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ক্রিকেট লীগে।

১৯৫১ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলা শুরু করে ইস্টএন্ড দলে খেলতেন। ১৯৫২ সালে তার অধিনায়কত্বে ক্লাবটি প্রথম বিভাগে উন্নীত হয়। ১৯৫৭ সালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে খেলে কলকাতা যান। যোগ দেন ইস্পাহানি ক্লাবে। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়েও খেলেছেন। খেলেছেন ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইট টিমে। ১৯৫৯ সালে আগা খান গোল্ডকাপে শ্রীলংকার সঙ্গে খেলেন।

১৯৫৫-৫৬ এবং ১৯৫৮-৫৯ সাল পর্যন্ত প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে খেলেছেন শক্তিশালী দল ইস্টএন্ড ক্লাবে। ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন ১৯৫৫-৫৭ সাল পর্যন্ত।

বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ি জীবন শেষে রেফারি ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে জড়িয়ে পড়েন। প্রথম বিভাগ লীগে ফুটবল ও ভলিবল রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে ভলিবলের রেফারি ও পাকিস্তান ভলিবল দলের সহকারী ম্যানেজার ছিলেন। ষাঠের দশকে পাকিস্তান ভলিবল ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক হন।

ভলিবলের উজ্জ্বল অধ্যায়ের সঙ্গেও জড়িত আব্দুল হামিদ। ১৯৭৬-৮৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হয়ে ভলিবলকে নিয়ে যান উপজেলা পর্যায়ে। প্রবর্তন করেন জাতীয় যুব ভলিবল প্রতিযোগিতার। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল ব্যাংকক এশিয়ান গেমস, তুরস্কের ইজমিরে প্রথম ইসলামিক সলিডারিটি গেমস, দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমসে অংশ নেয়। সফর করে রাশিয়ায়। দু’বার এশিয়ান ভলিবল কনফেডারেশনের পরিচালক ছিলেন তিনি।

ধারাভাষ্যকার হিসেবে আবদুল হামিদের পরিচয় অনন্য। ষাটের দশকে রেডিওতে প্রথম দেশি-বিদেশি দলের খেলার ধারাবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুতে রিলে করা হলেও বাংলার গুরুত্ব ছিল না। খেলার বিরতিকালে বাংলায় সংক্ষিপ্ত বিবরণী দেওয়া হতো। এই সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিতেন আবদুল হামিদ।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পাকিস্তানি ক্রিকেটার আবদুল হাফিজ কারদার, জামশেদ জি মার্কার, কামরুদ্দিন বাটের সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে বসে ধারাবিবরণী দিতে দিতে আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। খেলা চলাকালে ধারাবিবরণীর অনুশীলন করতেন। এজন্য অনেকে তাকে পাগল বলতেন। প্রতীক্ষার পর ১৯৬৩ সালের আগস্টে প্রথববারের মতো তার কণ্ঠে বাংলায় ধারাবিবরণী সম্প্রচার করা হয়।

১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা স্টেডিয়ামে শহীদ মেজর ভাট্টি একাদশ এবং স্কোয়াড্রন লিডার আলম একাদশের মধ্যে প্রদর্শনী ক্রিকেট খেলায় প্রথম বাংলায় ধারাবিবরণী দেন তিনি।

রেডিওর পাশাপাশি টেলিভিশনেও ধারাবিবরণী দেওয়া শুরু করেন ১৯৬৬ সালে ঢাকা ফুটবল লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খেলা দিয়ে। আগা খান গোল্ডকাপ, আরসিডি ফুটবল প্রতিযোগিতা, ঢাকার মাঠে পাকিস্তান-ইংল্যান্ড, পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচে ধারাবিবরণী দেওয়ারও সৌভাগ্য হয় তার।

১৯৭০ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলায় ধারাবিবরণী দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নেপালে সাফ ফুটবল উপলক্ষে সরাসরি ধারাবিবরণী দেন। টেলিভিশন ও রেডিওর সংবাদ পাঠক আবদুল হামিদ চাঁদে যাওয়া তিন নভোচারী ঢাকায় এলে টেলিভিশনে সরাসরি ধারাবিবরণী দেন।

ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও দৈনিক জেহাদ, দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় লিখতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার ক্রীড়া বিভাগের প্রধান ছিলেন। চ্যানেল আইতে উপস্থাপন করেন ‘আই স্পোর্টস’। বাংলাদেশ টেলিভিশনে উপস্থাপনা করেন ‘স্বনামধন্য’ ম্যাগাজিনের।

কর্মজীবনে প্রবেশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। ১৯৬০ সালে যোগ দিয়ে ২৭ বছর চাকরি করার পর আল বারাকা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টও ছিলেন।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির প্রথম সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশ ফুটবল রেফারি সমিতির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ জনসংযোগ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর প্রাক্তন সদস্য, সোনালী অতীত ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছাড়াও কয়েকদিনের জন্য ছিলেন বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব।

‘বাংলায় ধারাবিবরণী/ধারাবিবরণীতে বাংলা’ নামে তার একটি গ্রন্থ ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রকাশ করেন মাসিক ‘খেলাধুলা’।

১৯৭৮ সালে বেতারব্যক্তিত্ব সম্মাননা লাভ, ১৯৭৯ সালে ভলিবলে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে কাজী মাহবুবউল্লাহ ও জেবুন্নেসা স্বর্ণপদক এবং ২০০৩ সালে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় একুশে পদক পান আব্দুল হামিদ।

ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্যের পিছনে মা বেলেজান বিবি, বড় ভাই আবদুল ওয়াহেদ ও স্ত্রী সাহেরা হামিদ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। ছোট দুই ভাই আবদুল তৌহিদ ও আবদুল সাঈদ ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিচিত। তিনি এক পুত্র ও এক কন্যার জনক।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০১২
এমআইএইচ/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ