ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘বাটার মোড়ের জিলাপি’ নামেই যার খ্যাতি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২৪
‘বাটার মোড়ের জিলাপি’ নামেই যার খ্যাতি

রাজশাহী: টসটসে রসে ভরা মুচমুচে জিলাপি। স্বাদ ও গুণে অনন্য রাজশাহীর ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’।

সুদীর্ঘ ৬৪ বছর ধরে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এ ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’। নামেই যার খ্যাতি। খুব জাকজমকপূর্ণ সাজসজ্জা নেই। নেই ভালো কোনো সাইনবোর্ড। এরপরও যুগ ধরে রাজশাহী মানুষের মন জয় করে রেখেছে এ জিলাপি। কেউ রাজশাহী বেড়াতে আসবেন আর এ জিলাপির স্বাদ নেবেন না তা কীভাবে হয়? তাই এক নামেই সবাই চেনেন এ জিলাপি। প্রতিবছর রমজানে এ জিলাপির চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।  

ইফতারে বেশিরভাগ রোজাদারই মুচমুচে জিলাপি পছন্দ করেন। আর ভোজনরসিক হলে তো কথাই নেই। অন্যান্য ইফতার আইটেমের সঙ্গে মিষ্টি রসে ভেজানো এ জিলাপি যেন হয়ে ওঠে আরও মোহনীয়।  

আর সবার মনের খোরাক মেটাতে স্বাদ আর মৌ মৌ মিষ্টি সুবাসের জাদু নিয়ে এখনও টিকে আছে ঐতিহ্যবাহী ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’। রাজশাহী মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র বাটার মোড় এলাকায় গেলেই নাকে ভেসে আসবে এ মিষ্টি জিলাপির সুবাস। একটু নজর ঘোরালেই দেখতে পাওয়া যাবে বিশাল লোহার কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে গরম গরম জিলাপি।

এ পবিত্র রমজানের পড়ন্ত বিকেলে তাই রোজাদারদের কাছে ইফতারে অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’। সম্পূর্ণ কেমিক্যালমুক্ত ও কোনো প্রকার রং ছাড়াই আড়াই প্যাঁচের জিলাপি তৈরি হয় বলে প্রতিদিনের ইফতারের সময় ক্রেতাদের মন টানে বাটার মোড়ের এ জিলাপির প্রতি।

রাজশাহীতে এ জিলাপির প্রথম বিচরণ ১৯৬০ সালে। ওই সময় রাজশাহী মহানগরীর বাটার মোড়ে জিলাপি ব্যবসা শুরু করেন সোয়েব উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী। সেই সময় তার একমাত্র কারিগর ছিলেন জামিলী সাহা। তখন থেকেই ধীরে ধীরে প্রচলিত হতে থাকে এ জিলাপি। ১৯৭২ সাল থেকে জামিলী সাহার ছেলে কালী পদ সাহা (কালী বাবু) বাবার সঙ্গে জিলাপির কারিগর হয়ে উঠতে শুরু করেন। এরপর ১৯৮০ সালে জামিলী সাহা মারা গেলে কালীপদ সাহা প্রধান কারিগর হয়ে ওঠেন। এ শহরের মানুষের কাছে তিনি ‘কালিবাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। কালিপদ সাহা মারা যান ২০১৭ সালে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তার দুই শিষ্য সাফাত আলী ও শফিকুল ইসলাম জিলাপি বানাচ্ছেন।

২০০২ সালে সোয়েব উদ্দিনের মৃত্যুর পর তার চার ছেলে সোহেল, শামীম, নাইট ও এমরান আলী নাহিদ বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে শুরু করেন। স্বাধীনতার পর রাজশাহীর দৃশ্যপট ছিল পদ্মা নদী বিধৌত কেবল একটি ছোট্ট শহরের নাম। সেই শহর কালের পরিবর্তনে এখন পরিণত হয়েছে মহানগরে। কিন্তু শহরের পুরোনো সেই জিলাপির ঐতিহ্যবাহী আছে আগের মতোই।

শামীম বলেন, বাটার মোড়ের জিলাপির দোকানের যাত্রা শুরু ৬০ এর দশকে। নাম ছিল রানিবাজার রেস্টুরেন্ট। তাই তার বাবার প্রতিষ্ঠানটি অনেক পুরোনো। আর অনেক পুরোনো হওয়ার কারণে তাদের এ জিলাপির চাহিদা মানুষের কাছে রয়ে গেছে ঠিক আগের মতোই। এ জিলাপি ৬৪ বছর ধরে রাজশাহীর অনুপম ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখনও প্রতিদিন রাজশাহীর নতুন-পুরোনো ক্রেতারা ভিড় করেন জিলাপি খেতে। আর রমজান মাস এলে তাদের জিলাপির কদর বেড়ে যায় কয়েক গুণ। কেবল জিলাপির জন্যই পুরো হোটেল তৈরি করে দিয়েছেন তারা। এখন শহরজুড়ে এটিকে বাটার মোড়ের জিলাপির হোটেলই বলা হয়। যেখানে ঐতিহ্যবাহী জিলাপি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। তবে রমজান এলে নিজেদের বানানো সেমাই পাওয়া যায় এখানে। এছাড়া বড় আকৃতির নিমকিও পাওয়া যায়।

শামীম বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দাম বাড়ানো হলেও মান ধরে রাখা হয়েছে। গত বছর রোজার সময়েও ১৮০ টাকা কেজি দরে জিলাপি বিক্রি হয়েছে। এখন প্রতিকেজির দাম ২০০ টাকা রাখা হচ্ছে। কারণ জিলাপি তৈরির সব উপাদানের দামই বেড়ে গেছে। এখানকার কারিগররা মান অটুট রেখে বছরের পর বছর জিলাপি বানাচ্ছেন। স্বাদের কোনো হেরফের নেই। তাই সাধারণ সময়ে দোকানটিতে দিনে ৯০ থেকে ১০০ কেজি জিলাপি বিক্রি হলেও রোজায় তা বেড়ে ২০০ কেজিও ছাড়িয়ে যায়।

এখানকার কারিগর সাফাত আলী বলেন, সাধারণ চালের আটা, ময়দা ও মাষকলাইয়ের ডাল ব্যবহার করা হয় এ জিলাপিতে। এসব উপাদান পানিতে নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে রাখা হয় টানা ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। এরপর তেল দিয়ে জিলাপি ভাজা হয়। আর এ জিলাপিতে কোনো রং বা কেমিক্যাল মেশানো হয় না। তাই এ জিলাপি খেতে খুবই সুস্বাদু হয়।

দোকান মালিক শামীম বলেন, তাদের চার ভাইয়ের প্রত্যেকেরই অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু শুধুমাত্র বাবার ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠান টিকে রাখতেই তারা এখনও ধরে রেখেছেন জিলাপি ব্যবসা। তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এ ধারা অব্যাহত রাখতে চায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২৪
এসএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।