ঢাকা, শুক্রবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

কর্মজীবন থেকে বিদায় নিলেন ‘বেচি দই কিনি বই’ খ্যাত সাদা মনের মানুষ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২৩
কর্মজীবন থেকে বিদায় নিলেন ‘বেচি দই কিনি বই’ খ্যাত সাদা মনের মানুষ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: বেচি দই কিনি বই খ্যাত সাদা মনের মানুষ জিয়াউল হক তার কর্মজীবন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়েছেন।

সোমবার (২৬ জুন) তিনি ঘোষণা দিয়ে এ বিদায় নেন।

দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে দই বিক্রি করে তিনি যে সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন সেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মধ্য দিয়ে তিনি বাকি জীবনটা পার করতে চান।

আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মজীবনের সমাপ্তির শেষ দিনেও তিনি তিন হাজার টাকার দই বিক্রি করেন। এদিন তিনি তার নাতিকে নিয়ে বের হন জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় দই বিক্রি করতে। এ সময় কথা হয় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে।  

তিনি জানান, মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। দরিদ্র হওয়ার কারণে লেখাপড়ার ইতি টেনে পরিবারের হাল ধরেন এবং ১৯৫৫ সাল থেকে মাত্র ২০ বছর বয়স থেকে দই বিক্রি করতে গ্রামে- গঞ্জে বেরিয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু নিজে বঞ্চিত হলেও সমাজের অবহেলিত মানুষের কথা চিন্তা করে দই বিক্রির টাকা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে বই কিনতেন তিনি। মাঝে মধ্যে হাত পেতে কিছু অনুদানও গ্রহণ করেছেন বলে অকপটে স্বীকার করেন। ৮৯ বছর বয়সী এই সাদা মনের মানুষ দীর্ঘ ৬৮ বছর জেলায় জেলায় ঘুরে এভাবে তিলে তিলে ১৪ হাজার বইয়ের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন বিশাল এক লাইব্রেরি। বর্তমানে এ লাইব্রেরিটিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ের পাশাপাশি দেশি বিদেশি অনেক দুর্লভ বই রয়েছে। তিনি জানান, এ পর্যন্ত এ লাইব্রেরির পেছনে তার প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

এদিকে তার কর্মজীবন শেষ করার ঘোষণাটি স্মরণীয় করে রাখতে শিবগঞ্জের একটি সাহিত্য সংগঠন জিয়াউল হককে বেশ কিছু বই ও উপহার দিয়েছেন। এ সময় লেখক ও কবি শাহনেওয়াজ গামা, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা সুহৃদ সমাবেশের উপদেষ্টা আসাদুজ্জামান, প্রভাষক মামুনুর রশিদ উপস্থিত ছিলেন। একই দিন পাঠক সংগঠন, সুহৃদ সমাবেশ শিবগঞ্জ উপজেলা শাখা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই উপহার দিয়ে তাকে সংবর্ধনা দেয়।  

এ সময় উপদেষ্টা আকবর হোসেন, জেলা সুহৃদ সমাবেশে সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক, শিবগঞ্জ উপজেলা সুহৃদ সমাবেশে সাধারণ সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম, সহ সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুনসহ জেলা ও উপজেলার সুহৃদরা উপস্থিত ছিলেন।  

পেশায় দই বিক্রেতা এই সাদা মনের মানুষটির জন্ম ১৯৩৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিভৃত পল্লী ভোলাহাট উপজেলার ৩ নম্বর দলদলী ইউনিয়নের চামা মুশরিভুজা গ্রামে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর বর্তমানে তিনি বটতলা গ্রামে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছেন। স্থানীয়ভাবে জীবন ঘোষ নামে তিনি সমধিক পরিচিত হলেও বর্তমানে তিনি ‘সাদা মনের মানুষ’ নামে পরিচিত।

তাঁর বাবা মরহুম তৈয়ব আলী মোল্লা এবং মা শরীফুন নেছা। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার দৌড় ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে তিল তিল করে গড়ে তোলেন তাঁর পারিবারিক লাইব্রেরি। পাশাপাশি নিজে দরিদ্রতার সঙ্গে আজীবন লড়াই করে নিরবচ্ছিন্নভাবে সমাজসেবা করে যাচ্ছেন।

একজন সৎ মানুষ, একজন ভালো দই ব্যবসায়ী সর্বোপরি একজন অতি উৎকৃষ্টমানের দই প্রস্তুতকারক হিসেবে তাঁর নাম যেমন জেলা থেকে ছাড়িয়ে দেশজুড়ে তেমনি মনের অদম্য ইচ্ছায় বর্তমানে তিনি একজন সমাজ সেবক হিসেবেও পরিচিত।

তিনি প্রথমত অভাবগ্রস্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে বর্ষ শেষে আবার ফেরত নিয়ে আসতেন। পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানায় পাঠ্যবই, পবিত্র কোরআন মাজিদ ও এতিমদের পোশাক দেওয়া অব্যাহত রাখেন। বর্তমানে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগে ৫৫১ জন ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে আসছেন। জেলা ছাড়া রাজশাহীর বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও বই দেন তিনি। যেসব ছাত্রছাত্রী দূর-দূরান্ত থেকে বই নিতে আসেন, তাদের যাতায়াত খরচও দিয়ে থাকেন জিয়াউল হক। পবিত্র ঈদে গরিব-দুখীর মাঝে কাপড় বিতরণ এবং প্রচণ্ড শীতে দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্রও বিতরণ করেন।  

এছাড়া গ্রামের বিভিন্ন ছিন্নমূল মানুষকে ইতোমধ্যে তিনটি টিনের ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এতিমখানায় প্রতি ঈদুল আজহায় কোরবানির খাসি ক্রয় করে দেন তিনি। বিবাহযোগ্য কন্যার অভাবগ্রস্ত বাবাকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি রমজান মাসে ৩০ জন অসহায় নারীর পানাহারের ব্যয়ভার বহন করেন তিনি। প্রতি ঈদুল ফিতরে ৬শ’ শাড়ি, ২শ’ লুঙ্গি বিতরণ করে থাকেন তিনি।

জীবন ঘোষ আরও জানান, তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে নানাভাবে সম্মানিত করেছে। দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তি ও সংস্থা তাঁকে লাখ লাখ টাকা মূল্যের বই ও সেলফ দিয়ে সহায়তা করেছে। তাকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা এবং পরবর্তীকালে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশ করায় রাতারাতি তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসেন এবং হয়ে যান সাদা মনের মানুষ।

সাদা মনের এ মানুষটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ঢাকার সানি ডেইল স্কুল ২০০৮ সালে ৭০ হাজার ও এইচএসবিসি ঢাকার গুলশান শাখার ব্যাংক ম্যানেজার লাইলা খান ৭৫ হাজার টাকার বই দিয়েছেন। ২০০২ সালে ফ্রিডম ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-টিআইবির পক্ষে তাকে ২ লাখ টাকার বই, লন্ডন প্রবাসী ফজলুর রহমান ২শ পাউন্ড (১৭ হাজার টাকা) পাটিয়েছেন। এছাড়াও কানসাট গোপালনগর মোড়ের এক সার ডিলার, সোনামসজিদ স্থল বন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ তাকে সহায়তা করায় তিনি জনসেবার হাত প্রসারিত করার সুযোগ পান।

তিনি আরও বলেন, তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ রহনপুর স্কাউট দল, ভোলাহাট প্রেস ক্লাব, খুলনা পিপি কলেজ, শহিদ সাটু হলে জেলা প্রশাসন (১৯৯৩ সালে), চ্যানেল আই (শহীদ সাটু হলে, ২০০৫), নবাবগঞ্জ নয়াগোলা পাঠাগার, ২০০১ সালে ইটিভি (এক বছর বন্ধের পূর্তিতে) ও ২০০৮ সালে ফ্রিডম ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তাকে সংবর্ধনা দেয়। সর্বশেষ তার কাজে মুগ্ধ হয়ে ইউনিলিভার বাংলাদেশ ২০০৬ সালে তাকে ‘সাদা মনের মানুষ’ পদকে ভূষিত করে।

আলাপচারিতায় সাদা মনের মানুষ জিয়াউল হকের আকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তি জীবনে তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলেও ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন। পাশাপাশি তাঁর লাইব্রেরির জন্য প্রয়োজন একটি রিডিং রুম, সেলফ, কিছু চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চ ও চার্জার লাইট।

সবশেষে তিনি একটি লাইব্রেরি, তিনটি এতিমখানা, একটি ইসলামী মাদরাসা এবং ১০টি হাফিজিয়া মাদরাসা পরিচালনায় সময় দিতে বাকি জীবনটা ব্যয় করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী একমাত্র ছেলে মহাব্বত হোসেনকে লাইব্রেরির সব দায়-দায়িত্ব অর্পণ করে যাবার শেষ ইচ্ছা তার।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।