ঢাকা, সোমবার, ২৪ ভাদ্র ১৪৩২, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

শুধুই কি সামাজিক মাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদ, নেপালে কেন জেন-জিদের বিক্ষোভ?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৫৮, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫
শুধুই কি সামাজিক মাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদ, নেপালে কেন জেন-জিদের বিক্ষোভ?

নেপাল সরকারের বিরুদ্ধে জেনারেশন জেড-দের (জেন-জি) বিক্ষোভ এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে। সোমবার সকাল ৯টা থেকে কাঠমান্ডুর মৈতিঘরে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়ে প্রতিবাদ জানায়।

তাদের এই প্রতিবাদ সরকারের দুর্নীতি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্তসহ নানা কারণে।

কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ‘হামি নেপাল’ নেমে একটি সংগঠন এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। এর জন্য অবশ্য তারা আগেই অনুমতি নেয়। সংগঠনের চেয়ারম্যান সুধান গুরুং জানান, সরকারের পদক্ষেপ ও দুর্নীতির প্রতিবাদেই এই কর্মসূচি এবং একই ধরনের আন্দোলন সারা দেশেই চলছে।

আয়োজকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিক্ষোভের রুট ও নিরাপত্তা নির্দেশনা জানান। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম পরে বই হাতে বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
সবশেষ বিক্ষোভকারীরা নেপালের পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে, গেট টপকে পার্লামেন্টে প্রবেশ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও পানি কামান ব্যবহার করে।  

পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বানেশ্বর ও আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কারফিউ জারি করেছে কাঠমান্ডুর জেলা প্রশাসন কার্যালয়। প্রধান জেলা কর্মকর্তা ছবি রিজালের সই করা কারফিউ ঘোষণায় জানানো হয়, স্থানীয় প্রশাসন আইন ২০২৮-এর ৬(এ) ধারা অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

নিউ বানেশ্বর চৌক থেকে পশ্চিমে বিজুলিবাজার সেতু পর্যন্ত (এভারেস্ট হোটেল সংলগ্ন), পূর্বে টিঙ্কুনে চৌক পর্যন্ত (মিন ভবন ও শান্তিনগর হয়ে), উত্তরে আইপ্লেক্স মল সংলগ্ন রত্ন রাজ্য সেকেন্ডারি স্কুল পর্যন্ত এবং দক্ষিণে শঙ্খমূল সেতু পর্যন্ত এলাকা কারফিউয়ের অধীনে রাখা হয়েছে।

১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া জেনারেশন জেডের (জেন-জি) তরুণরা কাঠমান্ডু, পোখারা, বুটওয়াল, বিরাটনগরসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করছেন।

নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন বন্ধ হলো?

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সব নিবন্ধনবিহীন প্ল্যাটফর্ম এখনই বন্ধ করা হবে। কোম্পানিগুলোর জন্য ২৮ আগস্ট থেকে সাত দিনের সময় ছিল নিবন্ধন সম্পন্ন করার। কিন্তু গত বুধবার রাত পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম—মেটা (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ), অ্যালফাবেট (ইউটিউব), এক্স (সাবেক টুইটার), রেডিট বা লিংকডইন—নিবন্ধনের আবেদন জমা দেয়নি।

কর্মকর্তাদের মতে, টিকটক, ভাইবার, উইটক, নিমবাজ ও পপো লাইভ নিবন্ধিত হিসেবে তালিকাভুক্ত। টেলিগ্রাম ও গ্লোবাল ডায়েরি এখনও অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

মন্ত্রণালয় নেপাল টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে নিবন্ধনবিহীন প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করার জন্য। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গজেন্দ্র কুমার ঠাকুর জানান, কোনো প্ল্যাটফর্ম নিবন্ধন শেষ করলে তা পুনরায় চালু করা হবে।  

নেপাল সরকারের এই পদক্ষেপ বিদেশে থাকা লাখো নেপালির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রলাদ রিজাল বলেন, ৭০ লাখের বেশি তরুণ উচ্চশিক্ষা বা চাকরির জন্য নেপালের বাইরে আছে। এই নিষেধাজ্ঞা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগে বড় ধাক্কা দেবে।  

নেপালে তরুণরা কেন আন্দোলন করছে?

নেপালের রাস্তায় তরুণদের ক্ষোভ শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের কারণে নয়। বহু তরুণ বিক্ষোভকারীর কাছে এই নিষেধাজ্ঞা ছিল সরকারের বিরুদ্ধে জমে থাকা দীর্ঘ অসন্তোষের বিস্ফোরণ।

প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম বক্ল করে দেওয়ার প্রতিবাদ হিসেবে শুরু হলেও তা দ্রুত সম্প্রসারিত হয়ে দুর্নীতি, স্বৈরাচার এবং নেতৃত্বে জবাবদিহিতার অভাবের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।

২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী যুবান রাজভান্ডারি এএফপিকে বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা আমাদের আন্দোলনের সূচনা করলেও সেটিই একমাত্র কারণ নয়। আমরা নেপালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করছি। ’ তার এই বক্তব্যই তুলে ধরে এমন এক প্রজন্মের ক্ষোভ, যারা মনে করে রাজনৈতিক নেতারা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

২০ বছরের আরেক শিক্ষার্থী ইক্ষামা তুমরক জানান, তিনি সরকারের ‘স্বৈরাচারী মানসিকতা’র বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। তিনি বলেন, আমরা পরিবর্তন চাই। আগের প্রজন্ম হয়তো সহ্য করেছে, কিন্তু আমাদের প্রজন্মের ক্ষেত্রে এর ইতি ঘটাতেই হবে।

অনেক তরুণের জন্য এই আন্দোলন যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, তেমনি গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামও। বিক্ষোভে নামা ভারতী নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, বিদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। সরকার ভয় পাচ্ছে, নেপালেও যেন তেমন কিছু না ঘটে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কথিত ‘জেন জেড বিপ্লব’ আসলে গভীর ক্ষোভ ও হতাশার ফসল, যেখানে দুর্নীতি ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য বড় কারণ। তবে সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তই ছিল সর্বশেষ কারণ, যা ডিজিটাল প্রজন্মকে মোবাইল-ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে থেকে রাস্তায় নামিয়ে এনেছে এই বিক্ষোভে।

প্রধানমন্ত্রী কী বলছেন

প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি নিবন্ধনবিহীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, ‘জাতিকে দুর্বল করার যেকোনো চেষ্টা কখনোই সহ্য করা হবে না। ’  যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের বিরোধিতা বাড়ছে।

ক্ষমতাসীন দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (একীভূত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি বলেন, দল ‘সবসময় অসঙ্গতি ও ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং জাতিকে দুর্বল করে এমন কোনো কর্মকাণ্ড মেনে নেবে না। ’

তিনি আরও বলেন, ‘কয়েকজনের চাকরি হারানোর চেয়ে জাতির স্বাধীনতা অনেক বড়। আইন ভঙ্গ, সংবিধান অবজ্ঞা এবং জাতীয় মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অসম্মান— এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ’

আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।