ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২, ২৬ জুন ২০২৫, ০০ মহররম ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

কত দ্রুত পরমাণু কর্মসূচি শুরু করতে পারবে ইরান?

মিরকান মিশুক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৫৮, জুন ২৫, ২০২৫
কত দ্রুত পরমাণু কর্মসূচি শুরু করতে পারবে ইরান? একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র

ইসরায়েলের আগ্রাসনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। এতে ওই স্থাপনা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ইসরায়েলের ১২ দিনের লাগাতার আক্রমণে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই অবস্থা থেকে দেশটির পরমাণু কর্মসূচি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নানা আলোচনা চলছে।

একপক্ষ মনে করে, ইরান খুব দ্রুতই আবার তাদের কর্মসূচি পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে। অন্যপক্ষ বলছে, এই ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে এবং তা সহজ হবে না।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ক ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞ সিমা শাইন ব্রিটিশ পত্রিকা টেলিগ্রাফকে জানিয়েছেন, দেশটির গোপন স্থাপনাগুলোতে শত শত নয়, বরং হাজার হাজার উন্নত সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে, যেগুলো পারমাণবিক অস্ত্রে ব্যবহারযোগ্য ইউরেনিয়াম উৎপাদনে সক্ষম।

তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পরিচিত পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর আগেই দেশটি তার অধিকাংশ উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম গোপন স্থানে সরিয়ে ফেলেছিল। এর মানে, তেহরান এখনো একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সব সক্ষমতা রাখে।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি সামরিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা শাইন তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, আমি নিশ্চিত, কোথাও একটি গোপন স্থানে শত শত, সম্ভবত হাজারো সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে এবং সব উপকরণ তারা বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষণ করেছে। তারা হয়তো এখনই কিছু করতে পারবে না। হয়তো আগামীকালও না, তবে ভবিষ্যতে তারা নিশ্চয়ই পারবে।

এই সতর্কবার্তা এসেছে এমন এক সময়ে, যখন মার্কিন একটি গোপনীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদেশে চালানো বিমান হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেবল কয়েক মাসই পিছিয়ে দিতে পেরেছে। পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেনি।

নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় দুটি স্থাপনা ধ্বংস করা সম্ভব হলেও ভূগর্ভস্থ স্থাপনাগুলোর কাঠামো ধ্বংস করা যায়নি। এখনো অধিকাংশ পারমাণবিক উপাদান নিয়ন্ত্রণে আছে ইরানের এবং ছয় মাসের মধ্যেই তারা একটি বোমা তৈরি করতে সক্ষম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে বলেছিলেন যে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, তা প্রাথমিক মূল্যায়নে অতিরঞ্জিত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সূত্র মতে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইসলামি বিপ্লবী গার্ডকে (আইআরজিসি) ইরানকে ইসরায়েলি হামলা ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পূর্ণ ক্ষমতা দিয়েছেন।

টেলিগ্রাফকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এক ইরানি কর্মকর্তা বলেন, আইআরজিসি এখন ইরানে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তারা এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে।

অন্যদিকে শাইন বলেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ফোর্দো, নাতানজ ও ইস্পাহানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু ‘গোপন’ স্থাপনাগুলোর অস্তিত্বও তো রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ড দেশটির নেতৃত্বে জটিলতা সৃষ্টি করলেও ‘হুমকি’ এখনো রয়ে গেছে। আইএইএ গত চার বছরে দেশটির প্রধান প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করেনি।

আইএইএর হিসাব অনুযায়ী, ইরানের কাছে ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে ৪০০ কেজি, যদি তা ৯০ শতাংশে উন্নীত করা হয়, তবে ৯ থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি সম্ভব।

এই ইউরেনিয়ামের বর্তমান অবস্থা কী, তা এখনও জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে যে, এগুলো হামলার আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

শাইন বলেন, হামলার কয়েকদিন আগেই ইরান সংকেত দিয়েছিল যে তারা উপাদানগুলো একাধিক স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে। আমি নিশ্চিত নই যে ইসরায়েল জানে কি না সব উপাদান কোথায় আছে। ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ওপর যতটা ফোকাস করা হচ্ছে, তা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কারণ ইরানের কাছে টনকে টন ২৫ শতাংশ ইউরেনিয়াম রয়েছে সেগুলোও ৯০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। তারা জানে কীভাবে করতে হয়, এটি তাদের কাছে নতুন কিছু নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি আলাদা সূত্র টেলিগ্রাফকে বলেছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান স্থাপনা-কারিগরি সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও ইউরেনিয়াম অন্যত্র সংরক্ষিত রয়েছে, তবুও তারা দাবি করছে, সেসব জায়গাও ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের পরিচিত।

সূত্রটি জানায়, আমরা এখনো সবকিছু ধ্বংস করিনি, কিন্তু অনেক কিছুই করেছি... তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করেছি।

তারা আরও জানায়, ইরান হয়তো অন্য গোপন স্থানে আরও সেন্ট্রিফিউজ প্রস্তুত রেখেছে। তবে আমাদের খুব ভালো গোয়েন্দা তথ্য আছে। আমি বলছি না যে আমরা সবকিছু দেখি, কিন্তু অনেক কিছুই দেখি।

যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ১২৫টিরও বেশি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এবং প্রথমবারের মতো জিবিইউ-৫৭ বাঙ্কার ব্লাস্টার ব্যবহার করে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, বোমাগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে, তবে এগুলো ভূগর্ভস্থ হল পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে কি না তা নিশ্চিত নয়।

ফোর্দোর প্রবেশপথের রাস্তাগুলোতে পরে আবারও ইসরায়েলি হামলা হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় স্থাপনাটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি।

এর আগে ইস্পাহানে সংরক্ষিত ৪০০ কেজি ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে, কারণ স্যাটেলাইট চিত্রে হামলার আগের দিনগুলোতে তিনটি সাইট থেকেই ট্রাক দিয়ে মালামাল সরাতে দেখা গেছে।

ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ বেকি অ্যালেক্সিস-মার্টিন বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আপাতত বিধ্বস্ত হলেও যদি ইউরেনিয়াম ধ্বংস না হয় বা জব্দ না করা হয়, তাহলে এর পুনর্সমৃদ্ধি আমাদের ভাবনার চেয়েও দ্রুত হতে পারে। বড় সমৃদ্ধিকরণ প্ল্যান্ট ধ্বংস হলেও ছোট ছোট গোপন স্থানে সমৃদ্ধিকরণ চালিয়ে কর্মসূচি পুনরায় গঠন করা সম্ভব।

যদি ইরানের অস্ত্র-মান সম্পন্ন ইউরেনিয়াম ধ্বংস হয়েও থাকে তাহলে ইউরেনিয়াম খনন, গ্রাইন্ডিং (চূর্ণকরণ), প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পুনরায় সমৃদ্ধকরণের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, যা সম্পন্ন করতে বছরের পর বছর সময় লাগতে পারে। যদি ইউরেনিয়াম ধ্বংস না হয়ে থাকে তাহলে কৌশলগত চিত্র একেবারে পাল্টে যাবে।

এই প্রেক্ষাপটে ইরানের ভেতরে অন্তত আপাতকালীন সময়ের জন্য নেতৃত্ব কাঠামোতেও বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও সাবেক স্পিকার আলী লারিজানিসহ অনেক সিনিয়র রাজনীতিক আয়াতুল্লাহ খামেনির সঙ্গে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা করিয়ে দিতে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছেন।

একজন ইরানি কর্মকর্তা জানান, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) বর্তমানে ক্রমেই ক্ষমতা, প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে চলেছে। আইআরজিসিই এখন কার্যত দেশ চালাচ্ছে এবং তারা এটি সফলভাবেই রক্ষা করছে।

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর এই বাহিনী গঠিত হয় ইসলামি প্রজাতন্ত্র রক্ষার লক্ষ্যে এবং এটি ইরানের নিয়মিত সেনাবাহিনী থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করে।

ইউরেনিয়াম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের প্রশ্নে তিনি বলেন, এই উপাদানগুলো সুরক্ষিত আছে ও অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো উদ্বেগের কারণ নেই।

তিনি বলেন, আপনি যে ইউরেনিয়ামের কথা বলছেন, তার অবস্থান দেশের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাও জানেন না। খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন না, কারণ এটি নিরাপদ জায়গায় আছে এবং কাউকে কোনো ঝুঁকিতে ফেলবে না।

ইরানে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মজিদ তাখত-রাভানচি ইতোমধ্যে জানিয়েছে, ইরান এখনো পরমাণু অস্ত্রবিরোধী চুক্তির (এনপিটি) সদস্য থাকবে এবং শান্তিপূর্ণ প্রয়োজনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাবে।

এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।