ইসরায়েলের হামলায় কেঁপে উঠছে ইরানের রাজধানী তেহরান। কেউ কেউ শহর ছেড়ে চলে গেলেও রয়ে গেছেন অনেকে।
তেহরানের আরও লাখো মানুষ শহর ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। মাহিন বলেন, ‘আমি কোথায় যাব? আমি আমার বাসায়ই বেশি স্বস্তি পাই। ’
এই বাসিন্দার ঘরের অনেক কাছেই ইসরায়েলি হামলায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এই বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিয়েছিল মাহিনকে। তিনি বলছিলেন, ‘মনে হচ্ছিল, আমার পেটের সব যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। ’
কিন্তু তারপরও তিনি বললেন, ‘বারবার ব্যাগ গোছানো, খোলা আর নতুন করে খাবার কেনার ঝামেলায় আমি নেই। কারো তো থেকে যেতে হবে, বাসা পাহারা দিতে হবে, বাগানে পানি দিতে হবে। ’
তেহরান ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করা লোকজনের ভিড়ে প্রধান সড়কগুলো যানজটে থমকে গেছে শুক্রবারের প্রথম হামলার পর থেকেই। নতুন করে আরও অনেকে পালাতে চাইছেন, কারণ ইসরায়েল তেহরানের একটি জেলা খালি করার নির্দেশ দিয়েছে।
সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন অবিলম্বে তেহরান ছেড়ে যান। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনো সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি, তবে ট্রাম্প বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন।
১০ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই শহর থেকে ঠিক কতজন ইতোমধ্যে চলে গেছেন, তার কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাব নেই।
তবে হামলার কারণে শহরের চিরচেনা ব্যস্ততা স্তব্ধ হয়ে গেছে, যেন নববর্ষের ছুটির সময় চলছে। তবু মুদি দোকান, বেকারি, ব্যাংক, হাসপাতাল এবং পেট্রোল পাম্প খোলা রয়েছে।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষ হতাহত হয়েছেন। কেউ কেউ ঘরে রয়ে গেছেন, কেউবা ছুটছেন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে।
আবার অনেকেই এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে রাতে ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে থাকেন, দেখার চেষ্টা করেন কোথায় কোথায় আঘাত হেনেছে।
তেহরানের পশ্চিমাংশের এক মধ্যবিত্ত পাড়ার বাসিন্দা বলেন, ‘যখনই কোনো বিস্ফোরণ হয়, প্রতিবেশীরা জানালা কিংবা ছাদে চলে যান যেন আতশবাজি ফোটানো চলছে। ’
ব্যাংক, হাসপাতাল, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর কর্মীদের শহরে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যরাও অনেকেই স্বেচ্ছায় রয়ে গেছেন, বলছেন, যাই হোক, তারা শহর ছাড়বেন না।
শিরিন নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘আমি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সমর্থক নই, কিন্তু এখন ইরানের পাশে দাঁড়ানোর সময়। ট্রাম্প আর নেতানিয়াহু সরে যেতে বলেন, যেন আমাদের নিয়ে তারা ভাবেন। ১০ মিলিয়ন মানুষের শহর কীভাবে খালি হবে? আমি আর আমার স্বামী তাদের পথ পরিষ্কার করে দেব না। আমাদের মেরে ফেলুক। ’
অনেকের জন্য ইসরায়েলি হামলার ভয় অপেক্ষা পালানোর রাস্তায় ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা বেশি ভীতিকর। পেট্রোল পাম্পে দীর্ঘ সারি, জ্বালানি নেওয়া, অন্যদিকে নিরাপদ এলাকায় খাদ্য সরবরাহে ব্যাঘাত, সব মিলিয়ে পালানোর ইচ্ছেও কমছে।
তেহরান ছাড়ার আহ্বান এবং হামলার হুমকির কারণে ক্ষোভ বাড়ছে ইসরায়েল ও ট্রাম্পের প্রতি। তাদের বক্তব্য অনেককে ভয় ধরাচ্ছে, আবার অনেকের মনে জন্ম দিচ্ছে প্রতিরোধের শক্তি।
তেহরানের সাংবাদিক ফারিদ মোদাররেসি এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, ‘আমি তেহরানে থাকব। এটি ইরানের হৃদয়। তেহরান খালি করার প্রকল্পটি খুব বিপজ্জনক। ’ তিনি বলছেন, এটি সম্ভবত ‘একটি জটিল হাইব্রিড অভিযানের ভূমিকা’ হতে পারে, যার লক্ষ্য হয়তো ভূমি দখল।
ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে, এক ধরনের সংহতির ঢেউ। অনেকেই পোস্ট করছেন আশ্বস্ত করতে, তারা এখনো তেহরানে আছেন। স্থানীয় এক মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র লিখেছে, ‘আমরা তেহরানে আছি, সেবা দিতে প্রস্তুত। ’
ইসরায়েল যাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, তারা মূলত ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ। কিন্তু সমস্যা হলো—তেহরানে এসব কর্মকর্তার পাশে সাধারণ মানুষও থাকে। ফলে যখন কোনো ভবনে হামলা হয়, তখন শুধু টার্গেট নয়, আশপাশের সাধারণ মানুষও মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে।
ইরান সরকার তাদের কর্মীদের জন্য কম দামে বাসা তৈরি করে রেখেছে। কিন্তু অনেকেই সেই বাসা ভাড়া দিয়ে বা বিক্রি করে ভালো পরিবেশ কিংবা শহরের কেন্দ্রে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকেন। তাই এখন সরকারি কর্মকর্তা আর সাধারণ মানুষের বাসস্থান একই এলাকায়। এতে সাধারণ মানুষের বিপদ বেড়েছে।
ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন। মোহাম্মদ-রেজা জাফারগান্দি মঙ্গলবার বলেন, শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪৮১ জন হতাহত হয়েছেন।
তিনি সতর্ক করে বলেন, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা হলে গোটা অঞ্চলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ইসরায়েল এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষ্যগুলো এড়িয়ে চলছে। তবে নাতানজের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে এক হামলায় কিছু তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ইরান ও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক কর্তৃপক্ষ। যদিও সেটি খুব গুরুতর নয় বলে মনে করা হচ্ছে।
যারা শহর ছেড়েছেন, তারা এখন প্রিয়জনদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করছেন। পরিবারগুলো বিভক্ত হয়ে গেছে। সেখানে ইন্টারনেট ধীর করে দেওয়া হয়েছে তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে, ফলে দূরত্ব আর উদ্বেগ আরও বাড়ছে।
ইরান সরকার তার ইসলামি আদর্শ নয়, বরং জাতীয়তাবাদী আবেগকে সামনে এনে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছে।
তেহরানের ভানাক স্কয়ারে পৌর কর্তৃপক্ষ বিশাল ব্যানার টানিয়েছে প্রাচীন পারস্যের কিংবদন্তি তীরন্দাজ আরাশের, যিনি চূড়ান্ত আত্মত্যাগের প্রতীক। তাকে সামনে এনে জাতীয় গৌরব ও একতা জাগিয়ে তোলা হচ্ছে।
ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বুধবার বলেছেন, ইরানের মানুষ খুব শান্ত ও সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর আক্রমণের মোকাবিলা করছে। বিষয়টিকে তিনি জাতির শক্তি ও ভালো হওয়ার লক্ষণ বলে মনে করছেন।
তবু যখন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবছে, তখন অনেকেই আতঙ্কিত তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স মঙ্গলবার বলেন, ট্রাম্প হয়তো তেহরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা বন্ধ করার জন্য আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। এর ঠিক আগেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দাবি করেন
তবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র এখনো তা মানার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। ইরানি রাজনীতিকদের মতে, তেহরান খালি করার আহ্বান হলো এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, যার লক্ষ্য ইরানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।
ইনস্টাগ্রামে এক গৃহবধূ লেখেন, জীবনে কখনো তেহরানকে এত আপন লাগেনি। যারা পালিয়েছে, তারা শত্রুকে ঠিক তাই দিল যা তারা চায়। আগুনে পুড়লে কেবল পশুরাই পালায়, গাছেরা থেকে যায়, তাদের তো শিকড় আছে।