ভারতে যদি কোনো মন্ত্রী—তিনি প্রধানমন্ত্রী হোন বা কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হোন—গুরুতর ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে নির্দিষ্ট মামলায় কমপক্ষে ২০ দিন জেল হেফাজতে থাকেন এবং পরে সেই মামলায় পাঁচ বছর বা তদূর্ধ্ব মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, তবে তাকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীপদ থেকে অবিলম্বে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটি বিল আনায় চরম উত্তেজনা ছড়িয়েছে সংসদ ভবনে।
বুধবার সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় সংবিধান সংশোধনী বিল-২০২৫ পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বিলটি বিবেচনার জন্য পাঠানো হবে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে।
প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীসহ ভারতের যেকোনো মন্ত্রী যদি পাঁচ বছর বা তার বেশি কারাদণ্ডের শাস্তিযোগ্য অপরাধে টানা ৩০ দিন ধরে গ্রেপ্তার ও আটক থাকেন, তাহলে তাকে পদ থেকে অপসারণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিলে রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত মন্ত্রীকে তার পদ থেকে অপসারণ করবেন।
যদি প্রধানমন্ত্রী অপসারণের পরামর্শ না দেন, তাহলে ৩১তম দিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই মন্ত্রীর পদ বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ ধরনের অভিযোগে ৩০ দিন কারাগারে থাকেন, তাহলে ৩১ দিনের মধ্যে তাকে পদত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় তার পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেষ হয়ে যাবে।
একইভাবে, কোনো প্রতিমন্ত্রী ৩০ দিনের জন্য কারাগারে থাকলে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে রাজ্যপাল তাকে অপসারণ করবেন। যদি মুখ্যমন্ত্রী পরামর্শ না দেন, তাহলে ৩১তম দিনে তার পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ৩০ দিন কারাগারে থাকেন, তাহলে ৩১ দিনের মধ্যে তাকে পদত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় তার পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেষ হয়ে যাবে।
কেন্দ্রের এই নতুন বিল পেশের পরই সংসদে আলোচনার সময় প্রবল বিরোধিতায় নামেন বিরোধী দলগুলোর সাংসদরা। তারা হট্টগোল শুরু করেন। এক পর্যায়ে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিরোধীদলের কিছু সাংসদ বিলের কপি ছিঁড়ে ক্ষোভ দেখান। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, কাগজের টুকরো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
এদিন আরও দুটি বিল লোকসভায় পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এগুলো হলো—‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্রশাসনিক সংশোধনী বিল-২০২৫’ এবং ‘জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল-২০২৫’। কিন্তু বিরোধী সাংসদরা ওই দুটি বিলের কপিও ছিঁড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে ছুড়ে মারেন। ফলে বিরোধীদের হট্টগোলে সংসদ অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায়।
বিরোধীদের এ ধরনের আচরণের জন্য অমিত শাহসহ শীর্ষ কয়েকজন মন্ত্রী লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার সঙ্গে দেখা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন। একইসঙ্গে, লোকসভায় বিল পেশের পর বিরোধীদের হট্টগোলের কারণে ওই তিনটি বিলকে বিবেচনার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে বিরোধীরা বিলগুলোকে ‘কঠোর’ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছে। তাদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিজেপি বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলোকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার।
কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রা প্রস্তাবিত বিলের বিষয়ে বলেন, এই বিল পাস হলে মিথ্যা অভিযোগে কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে ৩০ দিন পর দোষী সাব্যস্ত না হয়েই তাকে পদ থেকে অপসারণ করা সম্ভব হবে। আমি এটিকে সম্পূর্ণভাবে বিরোধিতা করছি। দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থার নামে আনা এই সংশোধনী কেবল মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য। এটি সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী, অগণতান্ত্রিক ও অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
এই প্রসঙ্গে এআইএমআইএম সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি অভিযোগ করেন, ভারতকে একটি পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত চলছে। তিনি প্রস্তাবিত বিলটির তুলনা করেছেন হিটলারের গোপন পুলিশ বাহিনী ‘গেস্টাপো’র সঙ্গে।
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসও বিলটির বিরোধিতা করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, আজ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা ১৩০তম সাংবিধানিক সংশোধনী বিলের নিন্দা জানাচ্ছি। আমি এর নিন্দা জানাচ্ছি, কারণ এটি জরুরি অবস্থার চেয়েও ভয়াবহ পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ ভারতের গণতান্ত্রিক যুগকে চিরতরে শেষ করে দেবে। এই কঠোর পদক্ষেপ গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য মৃত্যুঘণ্টা।
ভিএস/আরএইচ