ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বিভীষিকাময় সুন্দরে-৯

ত্লাবং ঝরনায় যাত্রা সাঙ্গ, আবার ফিরবো এ শ্যামল সুন্দরে

রিয়াসাদ সানভী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৫
ত্লাবং ঝরনায় যাত্রা সাঙ্গ, আবার ফিরবো এ শ্যামল সুন্দরে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পূর্ব প্রকাশের পর

বান্দরবান থেকে ফিরে: আজ আমাদের ফেরার দিন। কেওক্রাডং ছুঁয়ে, সুন্দরতম জাদিপাই, জিংসিয়াম সাইতারের পর আজ ডবল ফলস বা ত্লাবং ঝরনা দেখেই ধরবো বাড়ির পথ।

রাতে ছিলাম সুংসাং পাড়ায়। গত কয়েকদিনের মতো আজকের সকাল গোমড়ামুখো না। সেই কোন ভোরে লাল টকটকে পুব আকাশে জানান দিলো উজ্জ্বল এক ভোরের। সকাল সাড়ে পাঁচটায় ওঠার কথা ছিলো। বরাবরের মতো আজও খানিক দেরি হয়ে গেলো। সকাল সাড়ে ছয়টায় কিছু না খেয়েই রওয়ানা দিলাম ত্লাবং ঝরনা দেখতে।

সুংসাং পাড়া থেকে মোটামুটি এক ঘণ্টার মতো লাগে এ ঝরনায় যেতে। ডবল ফলস নামে শহুরে আঙিনায় এটি বেশ পরিচিত। ডবল ফলস মূলত রেমাক্রি খালের উৎস। সুংসাং পাড়া থেকে রেমাক্রি খাল পর্যন্ত এ পথে শুধু নামা। রাস্তার আয়তনও বেশ প্রশস্ত। ভোরের আলোয় পথের ঘাসে লেগে থাকা শিশির ছুঁয়ে আমরা চলেছি ডবল ফলসের পথে। তিন দিনে পাহাড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে শরীর এখন পুরোপুরি ফিট। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। দূরত্বের কষ্ট না, ভাবাচ্ছে এখন ফেরার চিন্তা।

ভারী বর্ষণ এমনিতেই রুমা বাজারে একটা দিন খেয়ে দিয়েছে। আগামীকাল অফিসে যোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু পথের হিস‍াব বলছে সে আশায় গুড়ে বালি। নির্ধারিত সময়ের বাইরেও একটা দিন কাটাতে হবে। অফিসে ফোন করে জানানোরও উপায় নেই, নেটওয়ার্ক থাকলে তো! চিন্তা বাদ দিলাম, যাচ্ছি ডবল ফলস অ্যাডভেঞ্চারে, এত ভাবলে কি চলে!

রাস্তা ছেড়ে এবার ঝিরিতে নেমে এলাম। এটি মূলত ডবল ফলসের আপার স্ট্রিম। এখান থেকে নানা পথে পাহাড় ধোঁয়া পানি এসে ঝরনা হয়ে সৃষ্টি হয়েছে রেমাক্রি খালের। ঝিরি পুরোতে কয়েক জায়গায় বিপদে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। কয়েকদিন এত বৃষ্টি হয়েছে ঝিরিতে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। এক জায়গায় তো ইয়া বিশাল এক লাফ দিয়েও শেষ মুহূর্তে পা হড়কাতে হড়কাতে বেঁচে গেলাম। আবার খানিকটা চড়াই ভেঙে জুম ক্ষেতের পথ ধরলাম।

কাকতাড়ুয়ার মতো জুম ঘরগুলো খেত পাহারা দিচ্ছে। ফাঁকা এসব ঘরে থাকার ইচ্ছে বহুদিনের। সামনের কোনো সফরে থাকা হবে হয়তো। দূর থেকে শোনা গেলো পানির প্রবল গর্জন। তৌহিদ জানানো ডবল ফলসের কাছাকাছি আমরা। এবারের প্রবল বর্ষায় বান্দরবানের সব ঝরনার কাছাকাছিই ভূমি ধস হয়েছে। জাদিপাইতে এর ভয়ংকর অবস্থা চোখে পড়েছে। জাদিপাইয়ের মতো ডবল ফলসেও ভূমিধসের কারণে নীচে যাওয়ার পথ বন্ধ।

অনেক উপরে এক বিশাল পাথরের চাইয়ে বসে দিনের প্রথম সূর্যের আলোয় দেখলাম ডবল ফলস। রূপের আলোয় ঝলমল করছে ঝরনা ধারা। বিশাল পাহাড়ের দুই কোণ থেকে আলাদা দু’টি ধারা নেমে এসেছে। জিংসিয়াম সাইতারের মতো ঠিক বুনো ভাব নেই। আবার গৃহপালিতও না। এর বিশাল পটভূমিকায় নিজেকে মনে হলো অনেক ক্ষুদ্র। এই আমাদের বাংলাদেশ। এর পথে প্রান্তরে কত না ঐশ্বর্য ছড়ানো আছে, যার খবর আমরা ক’জন জানি।

ডবল ফলসকে পেছনে রেখে কিছুক্ষণ চরলো ব্যাপক ফটোসেশন। সকালের নাস্তা সারলাম। এবার ফিরতে হবে। রোদ দ্রুত মাথার উপরে উঠছে। বেলা পড়ার আগেই আমাদের থাকতে হবে বগালেকে। সুংসাং পাড়া ফিরতে আরও কম সময় লাগলো। সেখানে আরেক দফা পেট পূজো সেরে আমাদের এখন উঠতে হবে পাসিং পাড়া। বাংলাদেশের উচ্চতম এ গ্রামে উঠতে হলে আমাদের বাইতে হবে এক বিশাল পাহাড়ের চড়াই। গত পরশু এ পথ  দিয়ে আসার সময় থেকেই ভাবাচ্ছিলো এ চিন্তা। এবার বাস্তবতার মুখোমুখি হবার সময়।

কিন্তু বাস্তবে দেখলাম খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে না। কাঁধে ভারী ব্যাগপ্যাক নিয়ে খাঁড়াই বাইতে তো জান বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। বাস্তবে দেখি স্বাভাবিক যে টুকু সমস্যা হওয়ার কথা এ পথে চলতে তার বেশি হচ্ছে না। প্রায় দেড় ঘণ্টায় চড়াই টুকু শেষ করে পাসিং পাড়ার চায়ের দোকানে এসে থামলাম। সাথের অন্যেরা এলো অবশ্য আরও মিনিট দশেক পরে। এবার নিশ্চিন্ত। আর তেমন ভয়াবহ চড়াই ভাঙতে হবে না। বগালেক পর্যন্ত এখন শুধু নামা।

এ সুখেই কিনা বগালেক পর্যন্ত যেতে যতটুকু সময় লাগার কথা ছিলো তার চেয়ে বেশি সময় লাগিয়ে দিলাম। অবশ্য দার্জিলিং পাড়া থেকে বৃষ্টির মাঝে বগালেক যেতে যেতে একটা অঘটনই ঘটলো। যা টের পাই বগা গিয়ে। সেখানে গিয়ে পা চেক করার সময় পেলাম এক বিশাল জোকের অস্তিত্ব। এটি টেনে ছাড়াতেই শুরু হলো রক্তপাত। অনেকক্ষণ ধরে নানা উপায়ে চেষ্টা করেও তা কমানো যায়নি। এর মধ্যে প্রায় আধ ব্যাগ রক্ত বেরিয়ে পুরো মেঝে ভাসিয়ে দিলো। পরে তৌহিদের চেষ্টায় এক বুনো লতার রস দিয়ে ক্ষত স্থান বেঁধে দেওয়ার পর কমলো তা।

এরপরে ফেরার সেই বাধা গল্প। প্রায় পাঁচদিন পর মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলো। বগালেকে এখন আর সেই আগের পরিবেশ নেই। কোলাহল লেগেই আছে, শহুরে ছোঁয়া পাওয়া যায় এখানে। রাত কাটাতে হবে লেকের পারের কটেজে। আগামীকাল এগারো মাইল পর্যন্ত ট্রেক করে যেতে হবে। সেখানে থেকে ল্যান্ড ক্রুজারে করে রুমা বাজার, সেখান থেকে নৌকায় বান্দরবান, এরপর ঢাকা।

বলা হয় ট্রেকিংয়ে ফেরার রাস্তাই সবচেয়ে কঠিন। বাস্তাবেও তাই টের পেলাম। অথচ এ কয়দিনে অবলীলায় কত না কঠিন পথ পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন সমস্ত ক্লান্তি এসে যেনো ভর করেছে। আপাতত ঢাকায় ফিরে যোগ দিতে হবে সেই রুটিন জীবনের স্রোতে। সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতে যখন আবার ক্লান্ত হয়ে যাবো, ফিরো আসবে পাহাড়ের কোলে, এই ভয়ংকর সুন্দরে।

(সমাপ্ত)

বাংলাদেশ সময়: ০১৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৫
এএ

** কিশোরী জিংসিয়ামের মৃত্যুস্মৃতি বিজড়িত ‘সাইতার’
** অভিযান দুর্গম ঝরনা জিংসিয়াম সাইতার
** ঝরনা রানী জাদিপাই পেখম মেলে বসে...
** গা-ভর্তি জোঁক নিয়ে আকাশছোঁয়‍া কেওক্রাডংয়ে
** এভারেস্ট জয়ের ক্লান্তি নিয়ে যৌবনবতী বগালেকে
** ভরাযৌবনা শঙ্খ নদী হয়ে বগা লেকের পথে
** ২১ কিমি হেঁটে অবশেষে রুমায়!
** পাহাড়ের আড়ে বিধ্বস্ত বান্দরবানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।