টানা তিনদিন পরে বন্যার পানি নেমে গেলে ভেসে উঠেছে এর ক্ষত। বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও দুর্ভোগ বেড়েছে লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ে।
জানা গেছে, উজানের ঢল ও টানা ভারী বৃষ্টিতে হু হু করে বাড়ে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ। গেল সোমবার রাতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বিপৎসীমা অতিক্রম করে। মঙ্গলবার সকাল থেকে বন্যায় প্লাবিত হয় তিস্তা নদীর বাম তীরের জেলা লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলা অধিকাংশ এলাকা। টানা তিনদিনের বন্যায় ডুবে যায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলের ফসলি ক্ষেত। পানিবন্দি হয়ে পড়ে জেলার প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। পানির তোরে ভেসে গেছে মৎস্য চাষিদের পুকুরের মাছ। বিশেষ করে আমন ক্ষেত ও বীজতলা ডুবে যাওয়ায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তিস্তাপাড়ে। শুক্রবার পানি কমে গেলে জেগে উঠে বন্যার ক্ষত।
আমনের লাগানো চারা বন্যার পানিতে পচে গলে নষ্ট হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেতে শুধু মাটি বালু পড়ে রয়েছে, নেই কোনো চারা। কিছু ক্ষেতে চারা গাছ দেখা গেলেও শুক্রবারের প্রচণ্ড রোদে তা গলে পচে নষ্ট হচ্ছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে দ্বিতীয় দফার বন্যায় নষ্ট হওয়া আমন ক্ষেতে নতুন করে চারা লাগান নদী পাড়ের কৃষকরা। সেটাও তৃতীয় দফার বন্যায় তিন/চার দিন ডুবে থেকে নষ্ট হয়েছে। নতুন করে লাগানোর মতো চারাও নেই অধিকাংশ চাষির। ফলে আমন নিয়ে দুঃচিন্তার ভাঁজ পড়েছে তিস্তাপাড়ের চাষিদের কপালে।
টানা তিন/চার দিন পর বাড়ি ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও দুর্ভোগ কমেনি নদীপাড়ের মানুষের। পানির তোড়ে নষ্ট হওয়া ঘর বাড়ি বেড়া মেরামত করছেন। বন্যার পানির সঙ্গে ভেসে আসা ময়লা আবর্জনা ঢুকে পড়েছে প্রতিটি বাড়িতে। ঝোপ ঝাড়ে আশ্রয় নিয়ে সাপ পোকামাকড়। এসব সংস্কার করতে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে পানিবন্দি পরিবারগুলোর। বন্যার পানিতে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে নদীপাড়ের বেশ কিছু বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, তৃতীয় দফার বন্যায় জেলার ৯১৫ হেক্টর জমির আমন ক্ষেতে ও ৬৩ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। যার সামান্য কিছু নষ্ট হলেও নতুন করে রোপণ করার সময় রয়েছে।
তবে কৃষি বিভাগে এ তথ্য জানাতে নারাজ স্থানীয় চাষিরা। তাদের মতে, বন্যায় শুধু নদী পাড়ের ফসল ক্ষেত ডোবেনি। টানা ভারী বৃষ্টিতে সারা জেলার নিম্নাঞ্চলের ক্ষেত ডুবেছে। পানিতে তলিয়ে আছে চার/পাঁচদিন ধরে। ফলে কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি বলে দাবি চাষিদের।
হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের কৃষক নুরুজ্জামান বলেন, আমরা অনেক কষ্ট করে চাষাবাদ করি। কিছুদিন আগে একবার বন্যায় ডুবে গিয়ে আমার তিন বিঘা জমির আমন ধান নষ্ট হয়েছিল। চারা ক্রয় করে দ্বিতীয় দফায় রোপণ করেছিলাম। সেটাও এক সপ্তাহের ব্যবধানে বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হলো। এখন চারা কেনার টাকাও নেই। চারা রোপণ না করলে পরিবার খাবে কি? আমরা কীভাবে বাঁচবো জানি না।
তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা সফুরা বেগম বলেন, তিস্তা আমাদের সর্বনাশ করে দিয়েছে। বছরের পর বছর চাষাবাদে অনেক খরচ করেও আমরা লাভবান হতে পারি না। যা আবাদ করি, ঠিকমতো তার দাম পাই না। কিন্তু এবারের বন্যায় আমাদের সবকিছু শেষ করে দিল। সামনে দিনগুলো কেমন যাবে, আমরা কীভাবে বাঁচবো, সেটা কেউই জানি না। ত্রাণসহ তিস্তার স্থায়ী বাঁধ চাই।
শুক্রবার তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে দিনভর বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হয়। ফলে লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি কমে যাওয়ায় বেড়েছে ভাঙন। তিস্তার বাম তীরে বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কালীগঞ্জে দক্ষিণ ভোটমারী, হাতীবান্ধার সিন্দুর্না এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে সিন্দুর্না সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্যা বসতভিটা ফসলি জমি আর স্থাপনা।
সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আরিফুর ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়নের তিস্তা চরের আমন ক্ষেতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেছে তবে বেড়েছে ভাঙন। চর অঞ্চলের সিন্দুর্না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. সাইখুল আরিফিন বলেন, বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় আমন ক্ষেত সামান্য কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নদীপাড়ের চাষিরা বন্যাকালীন আপদের জন্য উঁচু এলাকায় আমনের বলান করে রাখেন। পানি নেমে গেছে নষ্ট হওয়া ক্ষেতে সেই আমনের বলান করা চারা রোপণ করতে চাষিদের প্রতি পরামর্শ দেন তিনি। আমনের চারা রোপণের এখনও সময় রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার জানান, তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পানিবন্দি পরিবারগুলোর মুক্তি মিলেছে। পানি কমলে নদীতে ভাঙন দেখা দেয়। সেদিক থেকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে নদীপাড়ে।
আরএ