সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের চারজন নিকট আত্মীয়কে তার মন্ত্রণালয়ের অধীনে ভুয়া সনদে চাকরি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার লালমনিরহাট প্রতিনিধির দায়ের করা অভিযোগটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে চিঠি পাঠিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
অভিযুক্তরা হলেন- সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের স্ত্রীর বড় ভাইয়ের মেয়ে শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান ট্রাস্টের (বাংলাদেশ) প্রশাসনিক কর্মকর্তা উম্মে হাবিবা, মন্ত্রীর মামাত ভাইয়ের মেয়ে মিরপুর আল নাহিয়ান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আরিফা খানম ও তার স্বামী লালমনিরহাট বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নুরুল আলম হবু এবং মন্ত্রীর মামাত ভাইয়ের ছেলের বউ মিরপুর আল নাহিয়ান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমিনা খাতুন।
সচিব বরাবরে পাঠানো জেলা প্রশাসকের চিঠি সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট ২ আসন থেকে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে নুরুজ্জামান আহমেদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও পরের দফায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে তার মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন। এসব নিয়োগ ও যোগদানে মানা হয়নি কোনো চাকরির বিধিবিধান। মন্ত্রী তার ইচ্ছেমতো চালিয়েছেন মন্ত্রণালয়। সরকার পতনের পরে দুর্নীতি ও হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন সাবেক এ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। এরপর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে তার অপকর্মের নানান নিদর্শন।
এসব নিদর্শনের একটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল-নাহিয়ান ট্রাস্টের (বাংলাদেশ) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ক্ষমতার প্রভাবে নিজের আত্মীয়দের নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। মন্ত্রী হিসেবে এ ট্রাস্টের সভাপতি ছিলেন তিনি। যার কারণে নির্বাহী আদেশে বিধি বিধানের তোয়াক্কা না করে আত্মীয় স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের একমাত্র যোগ্যতা তারা মন্ত্রী পরিবারের আত্মীয়। তাদের প্রতিটি নিয়োগ জাল জালিয়াতি ও অনিয়মে ভরা। ট্রাস্টের চাকরির প্রবিধান মালা (২০০৬) লঙ্ঘন করে এসব নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ।
অভিযোগে বলা হয়, ট্রাস্টের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগে স্নাতকোত্তর পাশ সনদ আবশ্যক হলেও গত ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি নিয়োগ পেয়েছেন মন্ত্রীর শ্যালকের মেয়ে এইচএসসি পাস উম্মে হাবিবা। পরবর্তীকালে দারুল এহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস একটি সনদ দাখিল করেন। ৬ মাসের মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দাখিল করবে মর্মে অঙ্গীকার নামা দিয়ে যোগদান করলেও অদ্যাবধি সনদ দাখিল করেননি। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তা উম্মে হাবিবাকে পরবর্তীকালে মিরপুর আল নাহিয়ান শিশু পরিবারের উপ তত্ত্বাবধায়ক পদে অতিরিক্ত দায়িত্বও দেওয়া হয়। বিধিমতে, উপ তত্ত্বাবধায়কের পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকার কথা হিসাব রক্ষণ অফিসারের। অথচ মন্ত্রীর ক্ষমতাবলে কেরানি পদের উম্মে হাবিবা উপ তত্ত্বাবধায়ক পদে অধিষ্ঠিত হন।
অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তা উম্মে হাবিবা মন্ত্রীর ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে ট্রাস্টের ফ্ল্যাট ভাড়ার টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। তার অবৈধ নিয়োগ বাতিল ও বিচার চেয়ে ট্রাস্টের কর্মচারীরা লিখিত অভিযোগও করেছেন। যা তদন্ত করে তার চাকরি বাতিলের সুপারিশসহ প্রতিবেদন ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালকের দপ্তরে ইতোমধ্যে দাখিল হয়েছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
একই পন্থায় ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদে আল নাহিয়ান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে গত ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি নিয়োগ পান মন্ত্রীর মামাত ভাইয়ের ছেলের বউ আমিনা খাতুন। তার পদে স্নাতকোত্তরসহ বিএড এমএড আবশ্যক। কিন্তু তিনিও বিএড এমএড সনদ ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন মন্ত্রীর আত্মীয়ের যোগ্যতায়। একই বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ২০১৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পেয়েছেন মন্ত্রীর মামাত ভাইয়ের মেয়ে আরিফা খানম। তিনি স্নাতক পাস করলেও তার বিএড সনদ ভুয়া। আরিফা খানমের স্বামী নুরুল আলম হবু'ও যোগদানের তারিখ জালিয়াতি করে পদোন্নতি নিয়ে হয়েছেন লালমনিরহাট বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক। সেই পদোন্নতিও মন্ত্রীর ক্ষমতার প্রভাবে যোগদানের তারিখ ২১ সাল থেকে ২০০৮ সাল দেখানো হয়। তার কোনো পদোন্নতি হয়নি বলেও দাবি করে নুরুল আলম বলেন, বিদ্যালয়ের জমি জবর দখলের প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিটি নিয়োগে ট্রাস্টের চাকরি প্রবিধি (২০০৬) লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। তাদের সবার শিক্ষাগত ও অভিজ্ঞতা সনদ ভুয়া ও জাল। যার কারণে পুলিশ ভেরিফিকেশন, এসিআর ও চাকরি স্থায়ীকরণও হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি ও হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ক্ষমতার অপপ্রয়োগে উল্লেখিত চারজন অযোগ্য আত্মীয় স্বজনদের অবৈধভাবে দেওয়া নিয়োগের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে ২৩ জুন একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার লালমনিরহাট প্রতিনিধি লাভলু শেখ। সেই ৪২ পাতার অভিযোগটি আমলে নিয়ে ওই দিনই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে পাঠান লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার।
অভিযোগকারী দৈনিক সংগ্রামের লালমনিরহাট প্রতিনিধি লাভলু শেখ বলেন, সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান ক্ষমতার অপব্যবহার করে অযোগ্য আত্মীয় স্বজনদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা সনদ ছিল না। তাদের একমাত্র যোগ্যতা মন্ত্রীর আত্মীয়। অযোগ্যরা রাষ্ট্রীয় পদে থাকলে দেশের দুর্নীতি বন্ধ হবে না। তাই উপযুক্ত প্রমাণাদিসহ ৪২ পাতার একটি অভিযোগ দাখিল করেছি। জেলা প্রশাসক অভিযোগটি আমলে নিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে পাঠিয়েছেন।
অভিযোগ বিষয়ে ট্রাস্টের প্রশাসনিক কর্মকর্তা উম্মে হাবিবা বলেন, সনদ দাখিলের অঙ্গীকার নামা দিয়ে যোগদান করেছি ঠিক আছে। তবে সময় উল্লেখ ছিল না। আর আমি আগের যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে অভিজ্ঞতার সনদ দিয়েছি সেই প্রতিষ্ঠান সনদ দিতে দেরি করায় আমি অঙ্গীকারনামা দিয়েছিলাম। মন্ত্রী পরিবারের আত্মীয় হওয়ার সুবাদে চাকরি হয়নি, যোগ্যতায় চাকরি হয়েছে। অযোগ্য বা ভুয়া হলে এতদিন তো থাকতে পারতাম না। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রফিক হায়দার বলেন, ৪২ পাতার অভিযোগটি পেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দেওয়া হয়েছে। তারা সেটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
আরএ