উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেতারবাদক ওস্তাদ খুরশিদ খান লোকান্তরে চলে গেলেও তার সৃষ্টি এবং বর্ণাঢ্য জীবন সবার কাছে সব সময় চির জাগরুক থাকবে। প্রয়াত এই সঙ্গীত দিকপালের মৃত্যুতে ১৭ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক সিটিতে আয়োজিত এক বিশেষ স্মরণ সভায় সমবেত সুধীজন তার অন্তর্ধানে শোকাহত না হয়ে তার যাপিত জীবনকে স্মরণ করে সবাইকে অনুপ্রাণিত হওয়ার আহ্বান জানান।
প্রবাসের বিশিষ্ট তবলাবাদক তপন মোদকের এলমাহাস্টের স্টুডিওতে আয়োজিত বিশেষ স্মরণ সভায় প্রয়াত ওস্তাদ খুরশিদ খানকে নিয়ে মার্চ মাসের শেষ দিকে নিউইয়র্কে একটি বড় মাপের অনুষ্ঠান আয়োজন এবং শিল্পীর বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে বিশেষ স্মরণিকা ও উত্তর আমেরিকায় আয়োজিত তার বিভিন্ন লাইভ কনসার্টের ভিডিও সংকলন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওস্তাদ খুরশিদ খানের বড় সন্তান নিউইয়র্কে বসবাসরত মূলধারার বিশিষ্ট সেতারবাদক মোরশেদ খান অপু এই মহান সঙ্গীত সাধকের ঘটনাবহুল জীবনের কিছু বিশেষ দিক সবার কাছে উপস্থাপন করেন। একাধিকবার নিউইয়র্ক সফরকালে ওস্তাদ খুরশিদ খান বিশিষ্ট শিল্পী মনিরুল ইসলামের আতিথ্য গ্রহণ করেন। স্মরণ সভায় মনির তার বক্তব্যে ওস্তাদের জীবনের নানা চমকপ্রদ অধ্যায় তুলে ধরেন।
বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক নাদিম আহমেদ তার শিল্পী জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ওস্তাদ খুরশিদ খানের অবিস্মরণীয় অবদানের বিষয়টি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। স্বাধীনতার পর এই কালজয়ী শিল্পী বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশে তার অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা করেন। সত্তরের দশকে ফ্রান্স থেকে শিল্পীর একটি বিশেষ লংপ্লে রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
নিউইয়র্কের স্মরণ সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, শিল্পী তাজুল ইমাম, মিনহাজ আহমেদ শাম্মু ও আকবর হায়দার কিরণ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শাহ মাহবুব, মাহবুবে খুদা রুমী, তানবীর সরওয়ার রানা, মোহাম্মদ আবদুল মোমেন, উর্মি খান, কনিকা দাস, সবিতা দাস, নিগার সুলতানা তাওহীদ, আলেয়া ফেরদৌসি, আজমাইয়া শোয়েব, লালন শোয়েব, তাহমিন আরা রহমান, শোয়েব কচি, মোস্তফা আরশাদ তারু এবং লিমন চৌধুরীসহ আরো অনেকে।
নিউইয়র্কে ওস্তাদ খুরশিদ খানকে স্মরণ করে যে কর্মযজ্ঞ হবে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট ছাড়া কানাডা থেকেও প্রতিনিধিত্ব থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিভিন্ন লাইভ কনসার্টে ধারণকৃত ভিডিও, স্থিরচিত্র ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ ডকুমেন্টারি নির্মাণ করবেন খ্যাতনামা চিত্র নির্মাতা এনায়েত করিম বাবুল। সঙ্গীত পরিচালক নাদিম আহমেদ তার স্টুডিওতে ধারণকৃত ওস্তাদ খুরশিদ খানের বিশেষ পরিবেশনা এ উপলক্ষে প্রকাশ করবেন।
ওস্তাদজীর জীবন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিতব্য বিশেষ স্মরণিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করবেন সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ এবং তাকে সহযোগিতা করবেন মিনহাজ আহমেদ।
কিংবদন্তীর সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান ও ওস্তাদ আয়েত আলী খানের বংশধর ওস্তাদ খুরশিদ খান ১৯৩৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদকে ভূষিত ওস্তাদ খুরশিদ খান ১৯৬১ সালে তৎকালীন ঢাকা বেতারের সঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগ দেন। পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশনের সঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবে তিনি যোগ দেন ১৯৬৪ সালে এবং ১৯৯০ সালে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত এই দায়িত্বে বহাল থাকেন। চল্লিশ বছরেরও অধিককাল তিনি সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী ছায়ানটে। ওস্তাদ খুরশিদ খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিষয়ক বোর্ডের সদস্য হিসেবেও দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেন।
ওস্তাদ খুরশিদ খান ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইরান, ইরাক, কোরিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার প্রকাশিত অ্যালবামগুলোর ভেতর রয়েছে মিউজিক ফ্রম বাংলাদেশ নর্থ ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক ট্রিবিউট টু গ্র্যান্ড ফাদার ওস্তাদ আয়েত আলী খান ও রিলেশন।
মাইহার ঘরানায় সুদীর্ঘ ৫০ বছর অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তাকে ১৯৯৮ সালে ওস্তাদ আয়েত আলী খান স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করেন ২০০১ সালে। ওস্তাদ খুরশিদ খানকে জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয় ২০০৫ সালে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১২