ঢাকা: জাতীয় নির্বাচনের আগে এই স্বল্প সময়ে ‘কোনো রকম ঝুঁকি’ না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। একইসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক বজায়’ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জরুরি বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের সব অর্গানে যেন ব্যালেন্স থাকে, সেই চেষ্টা করতে হবে আপনাকে প্রধান উপদেষ্টা। আমরা চাই না প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর মধ্যে কোনো রকমের ভারসাম্য নষ্ট হোক। আমরা সেটা এফোর্ট করতে পারব না এ মুহূর্তে।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই, আপনার সঙ্গে প্রতিরক্ষাবাহিনীর সুসম্পর্ক বজায় থাকুক। রাষ্ট্রের একটা ব্যালেন্স থাকতে হবে। আমরা নির্বাচন সামনে রেখে কোনো রকমের ঝুঁকির মধ্যে যেতে চাই না, যেতে পারব না।
সরকার জুলাই সনদ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়ে গেছে। সেই মতপার্থক্য দূর করে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরকে ঘিরে অনিশ্চয়তা কাটাতে রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে এ বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন।
বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের দাবি জানায়, আর এনসিপি সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়—এ দুটি প্রস্তাবেরই বিরোধিতা করে বিএনপি।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের দোসর একটি দেশ এই সুযোগ নেওয়ার জন্য বসে থাকবে। সুতরাং আমাদের একদম অতি বিপ্লবী হলেও চলবে না।
একই সঙ্গে নির্বাচন বিলম্বিত না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের আপনার প্রতিশ্রুত সময়ে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অবশ্যই নির্বাচন করতে হবে। যার কোনো বিকল্প নাই এ জাতির সামনে। এমন একটা এটমস্ফেয়ার বজায় রাখতে হবে আমাদের, যে এটমস্ফেয়ার আর কখনও পতিত স্বৈরাচারকে সুযোগ নিতে দেবে না। যেভাবেই হোক দীর্ঘদিন অনির্বাচিত অবস্থায় সরকার পরিচালিত হলে যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেটা এখনও হয়েছে।
তিনি বলেন, সেজন্য আমরা বারবার তখন থেকেই পারসু করছিলাম, বলছিলাম যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচিত একটা রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। তা না হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যা কিছু দেখা গেছে, যা কিছু লক্ষণ, সে লক্ষণ এদেশেও উৎপত্তি হবে এবং হয়েছেও তাই। এখন আরও বিলম্বিত হলে আরও বেশি সমস্যা উদ্ভবের সম্ভাবনা বিস্তর।
গণভোট প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে সালাহউদ্দিন বলেন, এখন জাতীয় নির্বাচনের আগে চার মাস বাকি। দুই মাস আগে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। তার আগে থাকে দেড় দুই মাস। সে সময়ের মধ্যে আরেকটা বিশাল আয়োজন জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মত বাস্তবায়ন করা, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সেটা কতটুকু বাস্তব? এবং ফলাফল একই। সারা দেশের জনগণ সংস্কারের জন্য বসে আসে। সংস্কারের পক্ষে। সমস্ত রাজনৈতিক দল সংস্কারের পক্ষে। জাতি পক্ষে। এখানে নেগেটিভ ভোট কয়টা পড়বে হাতে গোনা যাবে। সবাই পজিটিভই দেবে।
তিনি আরও বলেন, একই দিনে ছোট্ট ব্যালটে যদি গণভোট হয়, তাহলে আমাদের জন্য সুবিধাজনক। এবং আলাদা ব্যয়ও হবে না। আলাদা ম্যানপাওয়ারও সেট করা লাগবে না। আলাদা নির্বাচনি বাক্সও হবে না। আলাদা বুথ সেন্টারও হবে না। অনেক কিছুই হবে না, আলাদা না হলে। আমরা মনে করি, যারা গণভোট আগে চাচ্ছে, এটা কতটুকু যৌক্তিক তা আপনারাই বিবেচনা করে দেখবেন এবং এটা নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস হলেও হতে পারে। আমাদের কাছে তাইই মনে হয়।
সব বিষয়ে আলাদা আলাদা প্রশ্ন সম্বলিত ব্যালটের মাধ্যমে গণভোটের বিপক্ষে অবস্থান জানিয়ে বিএনপির এ নেতা বলেন, এখন যদি সব বিষয়ে গণভোট হয় তাহলে তো আর ব্যালট হল না।
জুলাই জাতীয় সনদ বিষয়ক আলোচনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আজকে কেন উপদেষ্টা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আমি আমার ভাই আখতার (জাতীয় নাগরিক পার্টির-এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন) বক্তব্য দেওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। তো আখতারের বক্তব্য দেওয়ার পর বুঝলাম, এখানে কিছু সমস্যা হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর সংক্রান্ত বিষয়ে। তারপর এসে জামায়াতের নেতা আকন্দ (জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ) সাহেব যেটা বললেন, তাতে এটা সমৃদ্ধ হয়েছে। তার আগ পর্যন্ত যে সমস্ত নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে, জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের আগে এটা একটা ওয়ার্ম আপ প্রোগ্রাম।
তিনি বলেন, আমার মনে হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টা আপনি জাতিসংঘের সফরের সময়ে আখতার হোসেনকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারা হয়তো অনেককিছু বিষয়ে আপনার থেকে শিক্ষা পাবেন। আশ্বস্ত হবেন আপনার থেকে। আমরাও শেষে আশ্বস্ত হতে পারব। কিন্তু এখন দেখতেছি, আমরা সারারাত যা বললাম, সকাল বেলা উঠে আবার এটার রিপিটেশন। সেটা করা মনে হয়, আমাদের উচিত হবে না।
এ সময় ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকা বিষয়গুলো নিয়েও সমালোচনা করেন সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবই সবাই মেনে নিলে তো আর ১২ মাস আলোচনার দরকার ছিল না। সবাই সবকিছুতে একমত হলে তো এ চর্চার আর দরকার ছিল না উপদেষ্টা। আর সবগুলো প্রস্তাব, যেগুলো শ্রদ্ধেয় বদিউল আলম মজুমদার সাহেব দিয়েছেন আরকি, এগুলো সব কিতাবে মানায়। বাস্তবের সঙ্গে সেটার অনেক কিছুর মিল ছিল না, যেটা আলোচনায় দেখা গেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেগুলো সম্ভব, আমাদের কালচারাল স্ট্যাটাসে যেগুলো সম্ভব, আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে যেগুলো সম্ভব, ইভেন জুডিসিয়াল জাজমেন্টে সেগুলো দেয়, কারণ এটা ব্রিটিশ নয়, এটা আমেরিকা নয়, এটা বাংলাদেশ।
তিনি আরও বলেন, এখানে আমাদের ধর্মীয় কালচারকে বিবেচনায় নিতে হয়, আমাদের সামাজিক কালচারকে বিবেচনায় নিতে হয়, আমাদের দীর্ঘদিনের চর্চিত কালচারকে বিবেচনায় নিতে হয়।
বিএনপির এ নেতা বলেন, নোট অব ডিসেন্টের স্বাধীনতা তো আপনারাই দিয়েছেন আলাদা আলোচনার মধ্য দিয়ে। এখানে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম, আমরা আলোচনা করব এভাবে যে, আমরা প্রধান উপদেষ্টা প্রথম দিন থেকে যেটা বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোসহ সবাই যেসব বিষয়ে একমত হতে পারবে, সেগুলো সংকলিত হয়ে একটা জাতীয় সনদ হবে। এবং এ জাতীয় সনদটা নির্বাচিত সরকারের পার্লামেন্টে বাস্তবায়িত হবে। তার আগে এ সরকারের যেগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ থাকবে, অর্ডিন্যান্স জারির মধ্য দিয়ে, নির্বাহী আদেশের মধ্য দিয়ে, সেগুলো বাস্তবায়িত হবে। ইতোমধ্যে অনেক হয়েছে। এবং হচ্ছে প্রতিনিয়ত এগুলো। সুতরাং একটা সংসদ অতি অবশ্য জরুরি সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য।
এসবিডব্লিউ/আরআইএস