বিবিসি বাংলাকে দেওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দুই পর্বের সাক্ষাৎকার গত কয়েক দিন ধরে আলোচনার বিষয়বস্তু। দেশের সব সংবাদপত্র ও সম্প্রচার মাধ্যম যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে সাক্ষাৎকারের বিবরণ।
সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন। বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথাও তিনি বলেছেন। তারেক রহমানের সম্ভাব্য দেশে ফেরা প্রসঙ্গে ইরানের বিপ্লবী নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির দেশে ফেরার কথা স্মরণ করা যায়। বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক। ইরানের শাহ রেজা পাহলভির ‘হোয়াইট রেভল্যুশনের’ তীব্র বিরোধিতা করেন খোমেনি। শাহবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে খোমেনিকে প্রথমে গ্রেপ্তার এবং পরে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তিনি দীর্ঘ ১৫ বছরে প্রথম তুরস্ক, পরে ইরাক এবং শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সে নির্বাসনে থাকেন। শাহ রেজা পাহলভি গুপ্ত পুলিশ বাহিনী গঠন করে রাজতন্ত্রবিরোধীদের গুম ও হত্যা করার কাজে ব্যবহার করতেন। এতে শাহবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে। শুরু হয় দেশব্যাপী ধর্মঘট ও বিক্ষোভ। নির্বাসিত খোমেনি ফ্রান্স থেকে প্রতিদিন অডিও বার্তা পাঠাতেন। যা গোপনে ইরানে প্রচার হতো এবং লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যেত। ধীরে ধীরে পুরো দেশ শাহবিরোধী আন্দোলনে এককাট্টা হয়। অবশেষে দেশের মানুষের জনরোষ বুঝতে পেরে শাহ রেজা চিকিৎসার অজুহাতে ইরান ত্যাগ করেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি নির্বাসন থেকে নিজ দেশ ইরানে ফিরে আসেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর থেকে রাজধানীর তেহরান পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। যা তখনকার ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জনসমাবেশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে প্রথমে গ্রেপ্তার ও পরে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে এক-এগারোর সরকার তারেক রহমানকে শুধু গ্রেপ্তারই করেনি, তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। এ প্রসঙ্গে তারেক রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আমি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি, যেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনো আমাকে সহ্য করতে হয়। জেলজুলুম খেটেছি আমি। বিভিন্নভাবে মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়েছি। আমি রেখে এসেছিলাম ছোট ভাইকে। যে ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম, সেই ভাই এখন আর নেই। যেই সুস্থ মা-কে রেখে এসেছিলাম, সেই সুস্থ মা এখন সুস্থ নেই। শুধু অসুস্থই নন, ওনার ওপরে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে। একটি ঘর রেখে এসেছিলাম, যেই ঘরে আমি এবং আমার ছোট ভাই বড় হয়েছি, যেই ঘরে আমার বাবার স্মৃতি ছিল, যেই ঘরে আমার মায়ের বহু স্মৃতি ছিল, সেই স্মৃতিগুলো ভেঙে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তারেক রহমান শুধু নিজের ও পরিবারের ওপর নির্যাতনের কথাই বলেননি, তিনি স্বৈরাচারী সরকারের আদেশে হাজার হাজার মানুষের ওপর চালানো অত্যাচার-নির্যাতনের কথাও সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি আমার পরিবারের যেই কাহিনি তুলে ধরলাম, এটি শুধু আমার কাহিনি না বা আমার পরিবারের কাহিনি না, এরকম কাহিনি বাংলাদেশের শত না হাজার হাজার পরিবারের। যে পরিবারের বাবা, যে পরিবারের ভাই, যে পরিবারের স্বামী, তার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় হাসপাতালের বারান্দায় মারা গিয়েছে। তা না হলে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় জেলের ভিতরে মারা গেছে। সহায়সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তারেক রহমান নিজের ও পরিবারের ওপর নির্যাতনের কথা বলার পাশাপাশি দেশের মানুষের ওপর চালানো অত্যাচার নির্যাতন ও হত্যার কথা উল্লেখ করে নেতাসুলভ মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি প্রতিহিংসার কথা না বলে ওই সব অন্যায়, হত্যা ও নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী তাদের প্রত্যেকের বিচারের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি প্রতিশোধের কোনো বিষয় নয়, এটি ন্যায়ের কথা, এটি আইনের কথা, অন্যায় হলে তার বিচার হতে হয়।
আরেকটি ক্ষেত্রে তারেক রহমানের সঙ্গে আয়াতুল্লাহ খোমেনির যথেষ্ট মিল রয়েছে। নির্বাসিত খোমেনি ফ্রান্স থেকে প্রতিদিন দেশবাসীর কাছে অডিও বার্তা পাঠাতেন গোপনে। খোমেনির এই অডিও বার্তা ইরানে লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে যেত। যা শাহবিরোধী আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যায়। তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে স্বৈরাচারী সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি বিভিন্ন উপায়ে দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে গেছেন। নিয়মিতভাবে তিনি এ কাজটি করতেন। এর মাধ্যমে নেতা-কর্মীরা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেতেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সাংগঠনিক বিষয়- সবকিছুতেই তাঁর পরামর্শ থাকত। তিনি তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান কথা বলতেন। এখনো যা তিনি করে চলেছেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলেননি কেন- বিবিসি বাংলা তা জানতে চেয়েছে। এর জবাবে তারেক রহমান বলেছেন, ব্যাপারটা বোধ হয় এরকম না। আসলে আমি কথা ঠিকই বলেছি। বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় কোর্ট থেকে রীতিমতো একটা আদেশ দিয়ে আমার কথা বলার অধিকারকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমি যদি গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাইতাম, হয়তো গণমাধ্যমের ইচ্ছা ছিল ছাপানোর, গণমাধ্যম সেটা ছাপতে পারত না। এ প্রসঙ্গে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমি কথা বলেছি, সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন পন্থায় আমি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। আমি পৌঁছেছি মানুষের কাছে। কাজেই গণমাধ্যমে যে কথা বলিনি তা না। ইচ্ছা থাকলেও ছাপাতে পারেননি, হয়তো প্রচার করতে পারেননি। কিন্তু আমি বলেছি, আমি থেমে থাকিনি।
ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে গণতন্ত্রকামী সব দল ও সংগঠন ভূমিকা পালন করলেও বৃহৎ দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নেতা-কর্মীদের নামে দেওয়া হয় লাখ লাখ মিথ্যা মামলা। কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলীসহ অনেক নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়। যাঁদের আর কোনো সন্ধান পায়নি তাঁদের পরিবার। তৃণমূলের অসংখ্য নেতা-কর্মী বাড়িঘরে থাকতে পারেননি। তাঁদের পরিবারও হয়রানির শিকার হয়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনায় তারেক রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেকে আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে মনে করেন নাই। তারেক রহমান মনে করেন, ‘কোনো ব্যক্তি নয়, মাস্টারমাইন্ড গণতন্ত্রকামী জনগণ। ’ আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বিষয়ে বিবিসি বাংলার প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান বলেন, আমি অবশ্যই জুলাই আন্দোলনে আমাকে কখনোই মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখি না। এই আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো থেকে, প্রত্যেকটি দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাদের নেতা-কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে। তিনি আন্দোলনের মাঠে মাদরাসার ছাত্র, গৃহিণী, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজিচালক, ছোট দোকান কর্মচারী বা দোকানমালিক থেকে আরম্ভ করে গার্মেন্ট কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। তারেক রহমান এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সমাজের দল-মতনির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের অবদান আছে। কোনো দল, কোনো ব্যক্তি নয়, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।
নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনা ও দলগতভাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে যাওয়া, এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা প্রায় ৬৪টি রাজনৈতিক দল বিগত স্বৈরাচারের সময় যার যার অবস্থান থেকে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যে দলগুলোকে আমরা পেয়েছি আমাদের সঙ্গে রাজপথের আন্দোলনে, আমরা চাই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে।
সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতি, কূটনীতি, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে আমাদের কিছু করার নেই। বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল থাকবে। তাই আমাকে আমার দেশের মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, কূটনীতির ক্ষেত্রেও বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুণ্ন রেখে, এর স্বার্থ বিবেচনা করে এবং এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সব কিছু।
বিবিসি বাংলার সঙ্গে দুই পর্বের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে তাঁর নিজের দল বিএনপি ও গণতন্ত্রকামী অন্যান্য দলের ভূমিকা, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের মূল্যায়ন, চলমান রাজনীতি, নির্বাচন, সংস্কার, নির্বাচনে জয়ী হলে দেশ পরিচালনার ভাবনা-সর্ব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তবে তিনি অল্প কথায় সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি কোনো প্রশ্নের জবাবে বিতর্কে জড়াতে চাননি, সংযত থেকেছেন। কোনো প্রশ্নের জবাব এড়িয়েও যাননি। তারেক রহমান দ্রুত দেশে ফিরে এসে হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন-দেশবাসী এমনটাই প্রত্যাশা করে।
লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
ইমেইল : [email protected]