ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয় হলো একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের সর্বোচ্চ স্থান। যেখানে সে গবেষণা করবে ও পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিতে শিখবে।
‘শিক্ষা’ যে প্রতিষ্ঠান প্রদান করে, সে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের চিন্তা ও স্বপ্ন থাকতে হয় আধুনিক ও উন্নত। অন্য দশটা বিশ্ববিদ্যালয় যেসব নিয়মে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, ঠিক গতানুগতিকভাবে যদি আপনিও একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে যান তাহলে পার্থক্য কোথায় রইল! এর জন্য প্রয়োজন ব্র্যান্ডিং। এটা এমনিতেই তৈরি হয় না। সৃজনশীল চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে কাজ করলে ব্র্যান্ড ভ্যালুর পালক প্রতিনিয়ত যুক্ত হতে থাকে।
একজন মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠানের মূল প্রতিশ্রুতি হলো- শিক্ষা। প্রতিষ্ঠান কিভাবে শিক্ষা প্রদান করছে তা দেখার ও বোঝার বিষয়। আপনি স্পষ্ট করে প্রকাশ করুন কেন আপনার প্রতিষ্ঠান অন্যদের চেয়ে আলাদা। আধুনিক শিক্ষা, স্বল্প খরচ, দক্ষ শিক্ষক, উন্নত ক্যাম্পাস, কত বছরের সফলতা, ন্যাশনাল কিংবা ইন্টারন্যাশনাল অর্জন ও মডার্ন সিলেবাস ইত্যাদি বিষয়গুলোর মধ্যে আপনার ব্র্যান্ডের উদ্দেশ্য কী তা সুস্পষ্ট করুন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য সুশিক্ষা প্রদান করা। এ সেবামূলক কাজটি করতে গিয়ে ডিসিশন মেকিংয়ের আসনে যারা থাকেন তাদের অবশ্যই ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হয়। একজন অভিভাবক কেন তার সন্তানকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাবে, এখানে পড়ালেখা করার পর শিক্ষার্থী চাকরি জীবনে কিভাবে সফলতা অর্জন করতে পারবে— এসব প্রশ্ন প্রথমে আসবে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্র্যান্ড ভ্যালু ও এর পড়ালেখার মানে অনন্য বৈশিষ্ট্য বা ব্যতিক্রমী দিক থাকে তাহলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব বহুগুণ। শিক্ষার্থী বা অভিভাবক তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকেন, সবাই ফিউচার দেখতে পছন্দ করে। সেই কাজ যখন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে সহায়তা করে তখন তার প্রতি আস্থা তৈরি হয় ও ভর্তির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল অ্যাম্বাসেডর— এক. শিক্ষার্থী, দুই. শিক্ষক। জব মার্কেটে ভালো গ্রাজুয়েট তৈরির মাধ্যমে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যোগ্য ও মেধাবী গ্রাজুয়েট তৈরির জন্য প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক। বাংলাদেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থে ভালো গ্রাজুয়েট তৈরি করছে। পাস করার সাথে সাথে ভালো বেতনে সুন্দর চাকরি পাচ্ছে। ঠিক বিপরীত চিত্রও দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী গ্রাজুয়েট শেষ করেও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছেন কিন্তু কোনো চাকরি পাচ্ছেন না। তখন ওইসব গ্রাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সুনামের বিপরীতে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারলে এমনিতেই কোটি টাকার ব্র্যান্ডিং হয়ে যায়। আর শিক্ষকমণ্ডলী হলেন সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তি। তাদের গবেষণার সুযোগ করে দেওয়া, নতুন ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা, টেকনোলজির সঙ্গে আপডেট রাখা, ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা, সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইব্র্যান্ট থাকা এবং যথাযথ সম্মানি প্রদান করার মাধ্যমে তাদের অগ্রণী ভূমিকায় রাখতে হবে। এই দুটি দিক যদি সমানতালে এগুতে থাকে তাহলে অর্ধেক ব্র্যান্ডিং সম্পন্ন হয়ে যাবে আর ছোট-বড় অধিকাংশ চ্যালেঞ্জ তুড়িতে মিটে যাবে।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি সঠিক ও সফলভাবে পরিচালনা করতে হলে দরকার রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। পৃথিবী প্রতিদিন আপডেট হচ্ছে। সেই আপডেটের সঙ্গে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারে তাহলে পিছিয়ে যেতে হবে। নিয়মিত ডেভেলপমেন্টের বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আর মার্কেট যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রিসার্চ করা দরকার। ফ্যাকাল্টিরা লেখাপড়ার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গবেষণা করবে আর ইউনিভার্সিটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আলাদা মনিটরিং সেল বা দরকার রিসার্চ। কেন ভর্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে না, শিক্ষার্থীরা কোন বিষয়গুলো বেশি পছন্দ করে, ড্রপ আউট রেট কেমন, শিক্ষক ও কর্মকর্তার সুযোগ কেমন, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন দিকে বেশি ফোকাস ইত্যাদি বিষয়ে রিসার্চ করা জরুরি। সমীক্ষা ও জরিপ অনেক পুরনো কিন্তু এখনও দুর্দান্ত একটি পদ্ধতি। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্টেকহোল্ডার হলেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সমস্যাগুলো কথা শুনতে হবে এবং কী পদক্ষেপ নিলে দ্রুত সমাধান করা সম্ভব সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ আধুনিক যুগের শিক্ষার্থীরা কোনো ছলছাতুরি কিংবা গোঁজামিল অতিসহজে বুঝতে পারে!
সাধারণ মানুষজন কী আপনার বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সচেতন, এখানে লেখাপড়া করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কি সন্তুষ্ট? তারা কি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশংসার ফুলঝুরি ছড়ায়? এসব নিয়েও দরকার আছে রিসার্চ। ব্র্যান্ড সচেতনতা পরিমাপের জন্য ফোকাল গ্রুপগুলো নিয়ে কাজ করা, পাশাপাশি ব্র্যান্ড নিয়ে যে খ্যাতি অর্জন করেছে বা যে লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সেসবের প্রচারণার কাজে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত একত্রিত করা জরুরি। প্রতিযোগী বা সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে রিসার্চ করা খুব দরকার। তাদের ব্র্যান্ডিং অবস্থান ও কৌশল সম্পর্কে জানুন এবং উপলব্ধি করুন। তাহলে নিজ প্রতিষ্ঠানে শক্তিমত্তা এবং দুর্বলতাগুলো উন্মোচন করতে পারবেন। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমণ, বিদেশি ডিগ্রি অর্জন, দেশীয় ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রফেসর হায়ার করা ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের টার্গেট গ্রুপ আর একটি কলেজের টার্গেট গ্রুপ কিন্তু এক নয়। বয়সের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যারা মাস্টার্স প্রোগ্রাম করবে তাদের বয়স সীমা ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য স্থান ও টার্গেট গ্রুপ কারা তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় যাদের শিক্ষামূলক সেবা প্রদান করে তাদের ডেমোগ্রাফিক ডাটা, পছন্দ, অপছন্দ নিয়ে গভীরভাবে না ভাবলে সঠিক ব্র্যান্ড ভ্যালু পাওয়া যাবে না।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা জানেন তাদের স্বতন্ত্র গুণাবলীগুলো। তারা জানেন, কিভাবে তার প্রতিষ্ঠানকে সাজাতে হয়, কিভাবে মাথা উঁচু করে সুশিক্ষা প্রদান করতে হয়। তারপর দেখা যায়, শতাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাঠ কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিন্তু সবাই টপার হতে পারছে না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো প্রোগ্রাম একত্রে সফলতার মুখ দেখে না, কোনো একটি বা দুটি প্রোগ্রাম পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে লিড দেয়। আর সেই সাবজেক্ট নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হয়— ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবজেক্টটি ভালো! প্রতিষ্ঠানের অফার, স্বতন্ত্র গুণাবলী, বিশেষ ছাড়, মেধাবৃত্তি, উপহার ও সুবিধাগুলো বারবার প্রচার করা দরকার। টার্গেট গ্রুপের কাছে— মানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছে তথ্যগুলো প্রচারের সকল মাধ্যম ব্যবহার করুন। এতে ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধি পাবে।
একটি গবেষণা দেখায় যে, ৫০% এর চেয়ে বেশি গ্রাহক ব্র্যান্ডের মান বা প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে সেবা বা পণ্য ক্রয় করে। দর্শন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। দর্শন হচ্ছে একটি ভবিষ্যৎ গন্তব্য, আপনার প্রিয় বিদ্যাপিঠকে আগামীতে বা এখন থেকে দশ বছর পর কোথায় দেখতে চান। যেখানে উদ্দেশ্য বলতে বোঝায় আপনার দর্শন অর্জনের জন্য আপনি বর্তমানে যে কার্যাবলী করছেন বা পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন। যেমন বার্তা, ট্যাগলাইন, লোগো, এবং এমন আরও অনেক কিছু আপনার দর্শন এবং উদ্দেশ্যে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন।
অফলাইন ও অনলাইন মিলিয়ে অসংখ্য মার্কেটিং ও প্রচার মাধ্যম রয়েছে। নির্ধারিত টার্গেট গ্রুপকে নিয়ে গবেষণা করতে হবে যে তারা কোন মাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে বেশি অভ্যস্ত এবং সেই মাধ্যমটিকে আপনার ব্র্যান্ডের প্রচারণার জন্য ব্যবহার করতে হবে। যদি এমন একটি কোম্পানি থাকে যার সঙ্গে এমওইউ বা এমওএ করলে আপনার প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধি পাবে তাহলে সেগুলো করতে হবে। ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সেবা ও সুযোগ বিনিময়ের মাধ্যমে ব্র্যান্ডের বিকাশ ঘটাতে পারেন। এতে উভয় প্রতিষ্ঠানে ব্র্যান্ড সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতির সঙ্গে জড়িত থাকে প্রতিষ্ঠাতা বা পরিচালকদের নাম। যিনি বা যারা এই সেবামূলক কাজটি করেন তারা অবশ্যই সাহসী লোক। তারা অবশ্যই দেশ ও সমাজকে কিছু দিতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনাম মানেই আপনার ‘নাম’ সেখানে জড়িত। প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা ও গ্রাজুয়েটদের অর্জন অবশ্যই আপনাকে বহুদূরে নিয়ে যাবে। কারণ পৃথিবীতে যোগ্য ব্যক্তিরা সবসময় টিকে ছিল ও টিকে থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যান্ডিং নিয়ে কাজ করা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। অন্য কোনো সাধারণ বিনিয়োগ নয়, যে আপনি রাতারাতি ফলাফল দেখতে পাবেন। অপরিকল্পিত ও লক্ষ্যভ্রষ্ট পদক্ষেপে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসবে না। দরকার অনেক পরিকল্পনা এবং চিন্তার। মেধা, অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে উপযুক্ত কৌশল অবলম্বন করলে সফল ব্র্যান্ডিং সম্ভব ও চ্যালেঞ্জকে রিমুভ নামমাত্র কাজ।
লেখক
ইনচার্জ, জনসংযোগ বিভাগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি।