ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ মে ২০২৪, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

মাঠ না থাকায় ডিভাইসমুখী শিশুরা, বাধাগ্রস্ত মানসিক বিকাশ

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২২
মাঠ না থাকায় ডিভাইসমুখী শিশুরা, বাধাগ্রস্ত মানসিক বিকাশ ডিভাইসমুখী শিশুরা। ছবি: বাংলানিউজ

ফেনী: একটা সময় বিকেল হলেই শিশুরা চলে যেত বাড়ির পাশের মাঠে। ক্রিকেট, ফুটবল, গোল্লাছুটসহ বিভিন্ন খেলায় মত্ত থাকত তারা।

কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন মাঠের অভাবে শিশুরা খেলছে বাড়ির গ্যারেজে কিংবা রাস্তার গলিতে। তাদের দিন কাটে এখন কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে গেম খেলে। অধিকাংশ শিশুরা তো খেলারই সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।  

দিনে দিনে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত খেলাধুলার উপযোগী মাঠ হারিয়ে যেতে বসেছে। তার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত শৈশব ও তারুণ্যের উদ্যম। এখন তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ডিজিটাল ডিভাইসমুখী হয়ে উঠেছে শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম। অন্যদিকে একের পর এক মাঠ নানাভাবে দখল হচ্ছে। মাঠ দখল করেই নির্মাণ হচ্ছে বড় দালান।

ফেনী শহরের মহল্লায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ মহল্লায় নেই খেলার মাঠ। আর যেগুলোতে শিশুরা একটু খেলতে পারে সেটিও কারো ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা, বিল্ডিংয়ের পার্কিং কিংবা পৌরসভায় রাস্তায়। রিকশা কিংবা মানুষ চলাচল করলে বন্ধ রাখতে হয় খেলা। রাস্তার পাশে ড্রেন থাকায় তৈরি হচ্ছে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, বাড়ছে আহত হওয়ার শঙ্কা।

ফেনী পৌরসভার আওতাধীন নির্দিষ্ট কোনো মাঠের সংখ্যা আছে কিনা? জানতে চাইলে ফেনী পৌরসভার সচিব আবুজর গীফারী বলেন, পৌরসভার আওতাধীন নির্দিষ্ট কোনো মাঠ নেই। আছে রামতারা শিশুপার্ক। শহরজুড়ে যে কয়টা মাঠ আছে তার বেশিরভাগই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে অবস্থিত কিন্তু যার অধিকাংশ ছোট। ফলে খেলার সুযোগ না থাকায় শিশুদের শারীরিক ও মানসিক গঠন ব্যাহত হচ্ছে।  

কিন্তু খেলার মাঠের স্বল্পতার ফলে শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশ অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার প্রাদুর্ভাবে যখন সবকিছু বন্ধ তখন শিশু-কিশোররা গৃহবন্দী অবস্থায় হাঁফিয়ে উঠেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে তাদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে অবশ্যই খেলার মাঠগুলো পুনরুদ্ধার করে একটি স্বাভাবিক ও সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে তাদের বেড়ে ওঠার জন্য।

শিশুরা খেলাধুলা করতে না পারার প্রভাব সম্পর্কে ফেনী সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এ এস আর মাসুদ রানা বলেন, খেলার মাঠ না থাকায় শারীরিক পরিশ্রম না হওয়ায় অসংখ্য শিশু মোটা হয়ে যাচ্ছে। এতে করে তাদের শারীরিক বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এছাড়াও মাঠের অভাবে শিশুরা ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকছে। গেইমসসহ ফোনের আসক্তি বাড়ছে। ফলে চোখসহ মানসিক বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

ফেনীর ক্রীড়া সম্পাদক শরিফুল ইসলাম অপু বলেন, শিশু-কিশোররা না খেলতে পারলে তাদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ হবে না, ভালো খেলোয়াড় হবে না। খেলাধুলার জন্য পাইলট হাই স্কুল মাঠ আছে, সেটাও অনুপযোগী। সেখানে বখাটেদের আড্ডা থাকে।  ফলে খেলাধুলা ব্যাহত হচ্ছে। মহল্লায় শিশুদের রাস্তার মধ্যে খেলা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে। শহরে মাঠ নেই যেমন সত্য কিন্তু যেগুলো আছে খেলাধুলার জন্য উপযোগী করা যেতে পারে। পিটিআই মাঠ, গার্লস স্কুলের মাঠ, জেলা পরিষদের সামনের মাঠ শিশুদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা করলে ওই এলাকার শিশুরা খেলার সুযোগ পাবে। খেলার ব্যবস্থা না করে সংরক্ষণ করতে গিয়ে শহরের মাঠ কমে গেছে। পাশাপাশি জেলা স্টেডিয়াম শহরের বাইরে তাই কেউ যায় না। অন্যদিকে ওয়াপদাতে এখন খেলাধুলা ও হয় না।

দুশ্চিন্তায় অভিভাবকরা:

খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ না থাকায় ছেলেমেয়েদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় মা-বাবাসহ অভিভাবকরা। খেলাধুলা না করার ফলে শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যার আশংকা করছেন তারা।

শহরের বিভিন্ন পরিবারের অভিভাবক ও শিশুদের সঙ্গে কথা হয় এই বিষয়ে। ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপাল ইউনিয়নের বাসিন্দা লিজা আক্তার ছেলেমেয়েকে ভালো বিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য দুই বছর আগে শহরে এসে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। তার স্বামী প্রবাসী। তাদের নয় বছরের একটি ছেলে রয়েছে। শহরে এসে বন্দী জীবনের মতো পার করছে শিশুটি।

লিজা আক্তার বলেন, ভালো উদ্দেশ্য শহরে এসেছি। কিন্তু স্কুলেও ভালো মাঠ নেই। পাড়াতেও খেলাধুলার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। ফলে বেশিরভাগ সময় বাসায় কাটায়, কিংবা গ্যারেজে দৌড়াদৌড়ি করে। এতে করে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ছে না। চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে।

মশিউর রহমান নামে পুরাতন রেজিস্ট্রি অফিস এলাকার আরেকজন অভিভাবক বলেন, যখন ফেনীতে বসবাস শুরু করেছিলাম খালি জায়গা ছিল। আমরা নিজেরাও ছোটদের সাথে মজা করতাম। কিন্তু এখন প্রতিটা জায়গায় দালান নির্মিত হয়েছে। ছেলেমেয়েরা বের হয়ে যে একটু খেলাধুলা করবে সে সুযোগ নেই। এতে তারা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা যেমন দুরন্ত তার থেকে পিছিয়ে পড়ছে।

সাহেদিন ইসলাম নামে ৫ম শ্রেণীর একজন ছাত্র বলে, গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় বড় মাঠে খেলাধুলা করতাম। এখন ফ্ল্যাটের নিচে গ্যারেজে এক চিলতে খালি জায়গায় খেলতে পারি। সহপাঠীও থাকে না অনেক সময় নিজে নিজে খেলি।

বাড়ছে ইন্টারনেট আসক্তি:

খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ততা না থাকার ফলে ইন্টারনেটের প্রতি ঝুঁকছে শিশু-কিশোররা। বাইরে খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইল গেমসের প্রতি আসক্তি বাড়ছে তাদের। বিশেষ করে করোনার পর এই সমস্যা প্রকট আকার ধারন করেছে। বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ থাকায় শিশুরা ইউটিউবে ছড়া, গান, কবিতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমের ভিডিও দেখছে। ফলে মোবাইলের প্রতি আসক্তি বাড়ছে তাদের। এর ফলে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে মানসিক বিভিন্ন সমস্যায়।

খেলা বলতে তাদের কাছে মোবাইলে ও ল্যাপটপে ভিডিও গেইম। মাঠে না গিয়ে পারিবারিক অসেচতনতার কারণে নিজের অজান্তে মরণব্যধি গেইমসের দিকে ঝুঁকছে শিশুরা, প্রবেশ করছে নিষিদ্ধ ওয়েব সাইটে। প্রযুক্তির এমন অপব্যবহারে শিশুরা যেমন মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি শারীরিক ক্ষতির শিকারও হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে চোখের সমস্যাসহ নানান রোগে ভোগে শিশুরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার মধ্যে অনলাইনে ক্লাস হওয়ায় সারাদিনই শিশুরা বিভিন্ন কন্টেন্ট দেখতে অভ্যস্ত হয়েছে। এখানে ভালো-খারাপ দু’টোই আছে। সেখানে নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে অভিভাবকদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এছাড়া খেলার মাঠ না থাকায় ইনডোর গেমসের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। খোলা পরিবেশে যে প্রভাবটা শিশুদের মনের ওপরে পড়ার কথা তা পড়ছে না।

সানজিদা আক্তার নামে একজন অভিভাবক বলেন, ফেনীতে আসার দুই বছরে ছেলের চোখে চশমা লেগেছে, ওজনও আগের তুলনায় অনেকটা বেড়ে গেছে। বাসার নিচে গলির রাস্তায় ছেলেরা খেলাধুলা করে কিন্তু নিরাপত্তার জন্য যেতে দিতে ভয় লাগে। পাশাপাশি না যেতে যেতে এখন সে মোবাইলের প্রতি আসক্ত। সুযোগ পেলেই মোবাইলে সময় কাটায়। না দিলে খেতে চায় না। বাধ্য হয়ে দিতে হয়।

আকবর হোসেন নামে এক শিশুর সঙ্গে কথা হলে সে জানায়, প্রতিদিন সে বিকেলে মোবাইলে গেইমস খেলে। কারণ তাকে বাসার নিচে যেতে দেওয়া হয় না। এতে সে গেইম খেলাকেই উপভোগ্য মনে করছে।

মেহেদী হাসান নামে আরেকজন বলেন, খেলাধুলার কোনো জায়গা পায় না। সকালে পাইলট মাঠে গিয়ে একটু খেলার চেষ্টা করি।

শিশুদের এমন জীবন নিয়ে শঙ্কিত অভিভাবকরারা। শিশুদের ঠিকভাবে বেড়ে উঠার জন্য সঠিক নগরায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।

শাকিল খান নামে একজন সচেতন নাগরিক বলেন, শিশুরা মাঠে খেলতে না পারার কারণে ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে। ছোট বয়স থেকেই তারা খারাপ জিনিসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।  প্রজন্ম যারা বড় হচ্ছে তাদের জন্য এটি অপূরণীয় ক্ষতি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, শিশুরা এই অবস্থায় থাকলে তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি শারীরিকভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দ্রুত এসব সমস্যা সামাধানে কর্তৃপক্ষকে এবং সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ছোট হয়ে গেছে খেলার মাঠ:

শহরের অধিকাংশ পাড়াতে বা স্কুলে খেলার মাঠ না থাকলেও যেগুলো আছে অধিকাংশ মাঠ ছোট হয়ে গেছে। যেসব মাঠে শিশুরা খেলাধুলা করত সে মাঠ ভরাট করে তৈরি হয়েছে নতুন ভবন।  ফলে কিছু মাঠ আয়তনে ছোট হয়ে গেছে। এমন একটা সময় ছিল, যখন বিদ্যালয় বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠত বড় খেলার মাঠ। সেখানে ছিল শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা দৌড়াদৌড়ি আর কোলাহলের আওয়াজ শোনা যেতো। নানা বয়সী মানুষের হাঁটাচলা ছিল। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ দিলে স্কুলের এই চিরায়ত চিত্র ফেনী শহরে বিলীন হয়ে গেছে। বাণিজ্যিক ভবনে চলছে স্কুলের কার্যক্রম। ছোট ছোট শ্রেণীকক্ষে চলছে ক্লাস। অনেক ক্ষেত্রেই নেই ছোট্ট আঙিনাটুকুও। শহরের বড় বড় স্কুল যেখানে ৩ থেকে ৪ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে সেসব স্কুলেও নেই খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা। অনেক স্কুলে খেলার মাঠ ভরাট করে তৈরি হচ্ছে নতুন ভবন।

স্কুলের মাঠ ভরাট করে কোনো ভবন নির্মাণ যাতে না হয় সে বিষয়ে ফেনী জেলা প্রশাসনের আগস্ট মাসের জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় শিক্ষা প্রকোশলকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান।

তিনি বলেন, খেলার মাঠে স্কুল হবে না। স্কুলের মাঠ নষ্ট করে কোন ভবন হলে সাথে সাথে বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফেনী শহরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে এই বিদ্যালয়ে। মাঠ না থাকাতে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হয়। বার্ষিক প্রতিযোগিতাও বড় করে আয়োজন সম্ভব হয় না। একই চিত্র ফেনী মডেল হাইস্কুলেও।

এই বিষয়ে সেন্ট্রাল হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোমেনুল হক বলেন, মাঠ না থাকলে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ হয় না। অন্য কোনোভাবে মানসিক বিকাশ হলেও খেলাধুলা না করলে শারীরিকভাবে বিকাশের সুযোগ নেই। আমাদের আগ্রহ আছে, কিন্তু জায়গা না থাকাতে খেলাধুলার আয়োজন সম্ভব হয় না। শিক্ষকদের আন্তরিকতায় খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২২
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।