ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ মে ২০২৪, ০০ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

কড়াইল বস্তির চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের জেরে আলামিন খুন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০২২
কড়াইল বস্তির চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের জেরে আলামিন খুন

ঢাকা: রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তিতে ৪০ হাজার অবৈধ ঘর রয়েছে। এসব ঘর থেকে ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির জন্য আদায় করা টাকা সরকারি কোষাগারে না গিয়ে চলে যায় বস্তি নিয়ন্ত্রণ করা গ্রুপের কাছে।

মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খান ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান গ্রুপের মধ্যে বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে খুন হন যুবলীগ কর্মী আলামিন।

বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) আলামিন হত্যায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতারের বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ।

তিনি বলেন, কড়াইল বস্তিতে কমিটি গঠন ও বিভিন্ন বিষয়ে চাঁদাবাজিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। আলামিন হত্যায় পাঁচজনকে ২২ ও ২৩ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে তারা পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছে।

গ্রেফতাররা হলেন- মোহাম্মদ আলী, মো. খাজা, মো. আমজাদ হোসেন, মো. হুমায়ুন কবির রাসেল ও মাসুদ আলম। এ সময় তাদের কাছ থেকে বড় ছোরা, চাপাতি, ডিস্ক কুড়াল ও লোহার রডসহ দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

হারুন অর রশীদ জানান, কড়াইল বস্তির বিভিন্ন ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন এবং এর মাধ্যমে বস্তির ঘরভাড়াসহ অবৈধভাবে বিভিন্ন ইউটিলিটি সেবার অর্থ আদায় নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৭ আগস্ট রাতে বস্তির এরশাদ মাঠ ও নূরানী মসজিদ এলাকায় নুরু-কবির-আলী গ্রুপের সঙ্গে রিপন-জুয়েল-শুভ গ্রুপের মারামারির ঘটনায় আলামিন মারা যান।  

মূলত টিএন্ডটি, গণপূর্ত ও ওয়াসা ইত্যাদি সরকারি সেবা সংস্থার জমিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ হাজার ঘর। এসব ঘর অবৈধভাবে নির্মাণ, বরাদ্দ ও হস্তান্তরে মোটা অংকের চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। ঘরগুলোতে অবৈধভাবে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি চলে আসছে দীর্ঘদিন। এছাড়া ডিস সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, ময়লা বাণিজ্য প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও টাকা তোলা হয়। রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় এ চাঁদার টাকা তোলে ও ভাগ-বাটোয়ারা হয়।

ডিবিপ্রধান বলেন, দুটি গ্রুপ এ চাঁদাবাজি করে থাকে। এ চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়েই প্রায় প্রতিবছর খুনাখুনি হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

নতুন কমিটি গঠন নিয়ে এবাবের দ্বন্দ্ব শুরু
কড়াইল বস্তি মূলত ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত। যার শতকরা ৯০ শতাংশ পড়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার মধ্যে। মফিজুর রহমান এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।

কড়াইল বস্তির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাতটি ইউনিটে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুটি গ্রুপের বিবাদ চলে আসছে। গত ২২ জুলাই সাতটি ইউনিটের কমিটি হয়। সেগুলো হল- কড়াইল উত্তর-১, কড়াইল উত্তর-২, কড়াইল বউবাজার-পূর্ব, কড়াইল বউবাজার-পশ্চিম, কড়াইল-মশার বাজার, কড়াইল-গোডাউন বস্তি ওকড়াইল-স্যাটেলাইট ইউনিট।

আওয়ামী লীগ এ সাতটি কমিটির বেশির ভাগ পদে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খানের গ্রুপের প্রাধান্য পাওয়ায় স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের অনুসারীদের মধ্য থেকে শুধুমাত্র একটি ইউনিটের সভাপতি ও আরেকটি ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছে।

ডিবি জানায়, নুর আলম নুরু কড়াইল উত্তর-২/দক্ষিণ ইউনিটের সহ-সভাপতি হওয়ায় এ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে এবং মফিজ গ্রুপের জসীমউদ্দীন রিপনকে সেক্রেটারি পদ না দিয়ে রফিকুল ইসলাম রাজুকে সেক্রেটারি করায় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
 
দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের নেতারা চাঁদাবাজির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে নবগঠিত কমিটির নেতারা নতুন করে মাঠ দখলের অংশ হিসেবে নিয়মিত মহড়া করতে থাকে। গত ১৭ আগস্ট এশার নামাজের আগে কাদের খান গ্রুপের নুরু-আলী-কবির গ্রুপের মহড়ার এক পর্যায়ে তারা রিপন-জুয়েল গ্রুপের আওলাদকে সামনে পেয়ে মারধর করে।

অল্প সময়ের মধ্যে উভয় গ্রুপের লোকজন দল ভারি করে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এশার নামাজ চলাকালে নুরু গ্রুপের আমজাদ এবং ভাতিজা মাসুদ নূরানী মসজিদে নামাজ পড়াকালীন রিপন-জুয়েল গ্রুপের লোকেরা মসজিদে গিয়ে তাদের প্রথমে জিআই পাইপ ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে হাত ভাঙাসহ মাথা-শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কোপায়।

নুরুর নেতৃত্বে ভাইগ্না আলী, মোহাম্মদ আলী, কবির, আজিজুল, খাজা, আমজাদ গং আরও হিংস্র হয়েও ওঠে একাধিক ঘর ও দোকান ভাঙচুর করে।  নুরু-কবির ছোরা-চাপাতি নিয়ে আলামিন ও নাসিরকে হত্যার উদ্দেশে কুপিয়ে জখম করে। নাসির ও আলামিন দৌড়ে মসজিদে প্রবেশ করলে সেখানেও তাদের আক্রমণ করে।  

গুরুতর আহত আলামিন প্রথমে ভাঙাড়ির দোকান ও পরে এরশাদ মাঠের একটি ফার্মেসির দোকানে ঢুকলে সেখানেও তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একটি রিকশায় উঠলে সেন্টু রিকশাওয়ালাকে মারধর করে। এ সময় খাজা ও আমজাদ এসে আলামিনকে আবারও মারধর করে এবং হাসপাতালে যেতে বাধা দেয়।

পরে রিকশাওয়ালা সামনে একটি রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল পেয়ে তড়িঘড়ি করে আলামিনকে তুলে দিয়ে প্রথমে মেট্রোপলিটন হাসপাতাল ও পরে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার পথে আলামিন মারা যায়। উভয় পক্ষের নাসির, নুরুসহ প্রায় ১০ জন গুরুতর আহত হয়।  

চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে বার বার সহিংসতা 
লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজির এ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বার বার একের পর এক সহিংসতা এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটে আসছে কড়াইল বস্তিতে। ২০১২ সালে কড়াইল বস্তির পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস প্রভৃতির সেবা/সংযোগের অর্থ উত্তোলনের ক্যাশিয়ার বশির হত্যাকাণ্ড, ২০১৪ সালে একই কার্যক্রমে নিয়োজিত দুলাল সরদার হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার কারণে তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসাইন হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে একই  ইস্যুতে নিহত হয় রাশেদ কাজী নামে একজন পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট কাম চাঁদাবাজ। সর্বশেষ ২০২২ সালে আলামিন হত্যার ঘটনা ছাড়াও আরও একাধিক হত্যাকাণ্ড ও সহিংস ঘটনা ঘটেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০২২
পিএম/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।