ঢাকা, বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ মে ২০২৪, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বাল্যবিয়ে রোধে তিন তরুণীর দীপ্ত পথচলা

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০১ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০২২
বাল্যবিয়ে রোধে তিন তরুণীর দীপ্ত পথচলা

ফেনী: একটা সময় আমাদের দেশে হর-হামেশাই ঘটতো বাল্যবিয়ে। এ কারণে প্রতি বছর অকালে ঝরতো অনেক কিশোরীর প্রাণ।

সেই প্রবণতা এখন অনেকটাই কমেছে। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় এখন বাল্যবিয়ের হার কমে বেড়েছে কিশোরীদের স্কুলগামীতা। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক কিশোরী-তরুণী নিজেরাই মাঠে নেমেছে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে।

ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় স্কুল ও সংগঠনের বন্ধুদের নিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে দারুণ ভূমিকা রাখছেন তারা। এমনই তিন জনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে বাংলা নিউজের পাঠকদের জন্য।

প্রিয়াঙ্কা হালদার: মেহেরপুর জেলার কিশোরী প্রিয়াঙ্কা হালদার। এখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত একটি কলেজে অনার্সে পড়ছে। বাল্যবিয়ে বন্ধে তিনি প্রথম প্রদক্ষেপ নেন যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সহপাঠীর বাল্য বিয়ে আটকে দিয়েছিলেন প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়াই। সেই থেকে আর তার পথচলা থেমে থাকেনি। মোট ১০৮টি বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছেন এই অপ্রতিরোধ্য তরুণী।

প্রিয়াঙ্কা জানান, প্রাথমিক ভাবে একাই এ কার্যক্রমে নামলেও পরে তাকে জেলা প্রশাসন সহযোগিতা করেছে। তাদের সহযেগিতার কারণে কাজ করতে সুবিধা হয়। বাবাও তাকে এ কাজে অনেক সহযেগিতা করেছেন। ক্ষুদ্র মৎস্য ব্যবসায়ী হয়েও মেয়ের এ কাজে পুরোপুরি সহযোগিতা করেছেন।   প্রিয়াঙ্কা বলেন, নিজের জেলা মেহেরপুর হলেও ২০১৮ সালে প্রশাসনের সহায়তায় পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গায় একটি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছিলেন।

প্রথম বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘তা ছিল ভয়ঙ্কর- মেয়েটির অভিভাবকরা তেড়ে এসেছিলেন, বলেছিলেন আমাদের মেয়ে আমরা বিয়ে দেব তোমাদের কি? সে সময় অনেক বোঝানোর পর তারা বিয়ে থেকে সরে আসেন। সেই মেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।  

নিজেকে কোন যায়গায় দেখতে চান- জানতে চাইলে প্রিয়াঙ্কা জানান, ভবিষ্যতে একজন সুদক্ষ জেলা প্রশাসক হিসেবে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে যে যে কাজ করণীয় এবং যে যে পদক্ষেপ নিলে আর একটি কিশোরীকেও অকালে ঝরে পড়তে হবে না, বাল্যবিয়ের শিকার হতে হবে না দৃঢ় হাতে সেই সব পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে নেব নিজেকে, সমাজ এবং দেশটাকে।

সানজিদা ইয়াসমিন খুশি: দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মেয়ে সানজিদা ইয়াসমিন খুশি। গরীব বাবার মেয়ে সানজিদা উত্তরবঙ্গের একটি উপজেলায় বসবাস করেও সেখানে ৬টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন। নিজের বাবা, স্কুলের শিক্ষকও সংগঠনের বন্ধুদের নিয়ে প্রশাসনকে জানিয়ে বাল্যবিবায়ে বন্ধের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

প্রথম বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছিলেন ৮ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। সে অভিজ্ঞতার বিষয়ে সানজিদা বলেন, বাল্যবিয়ের খবর শুনে আমি আগে মেয়েটার বাসায় যাই। দেখি তার বয়স খুবই কম। তারপর মেয়েটার পরিবারকে বলি এটা তো বাল্যবিয়ে। তখন তারা একটা সার্টিফিকেট দেখায়, যেখানে জন্ম সাল পরিবর্তন করা হয়। আর ওটা বোঝা যায় ইংলিশ লেখা পরিবর্তন করলেও বাংলাটা না করায়। কিন্তু আমার কথা তারা শুনতে রাজি হয়নি। তখন আমি উপজেলায় ইউএনও স্যারের কাছে যাই। অনেকক্ষণ পর ওনার সঙ্গে দেখা করে সব বলি। ইউএনও সাহেব মেয়েটির অভিভাবকদের ডাকেন। ওরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিয়ে দেবে না। কিন্তু রাতেই সেখানে প্রায় ৩০ জন জড়ো হয়ে যায়। অনেক বোঝাপড়ার পর বিয়েটা আর হয়নি। সেই রাতে প্রথমে খুব ভয় লেগেছিল, যখন আমাকেই আটকিয়ে দিয়েছিল, কাঁপছিলাম পুরো। আমি তখন ৮ম শ্রেণিতে পড়তাম। তখন বাসায় কল দেওয়ার পরে বাবা গিয়ে নিয়ে এসেছিল আমাকে।

সানজিদা বলেন, এরপরের কাজগুলো করতে তেমন কষ্ট হয়নি। উপজেলা প্রশাসনকে বললে তারা ঘটনাস্থলে  গিয়ে পুলিশের সহায়তায় বিয়ে বন্ধ করে দিতেন। তবে একজন ইউএনও ছিলেন, যিনি সহযোগিতা তেমন করতেন না। বললেও সাড়া দিতেন না। ওই সময়ে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে হতো। মেয়ের বাবাকে বলতাম প্রশাসনকে জানিয়ে এসেছি, বিয়ে বন্ধ না করলে ওনারা এসে জরিমানা করবেন। পরে এমনিতেই বন্ধ হয়ে যেত। আর যাদের মেয়ের বিয়ে বন্ধ হয়ে যেত তাদের সঙ্গে একটা বৈরীতা সৃষ্টি হতো।  

নিজের পরিকল্পনা নিয়ে এ কিশোরী বলেন, অবশ্যই আমি চাই বাল্যবিয়ের  জন্য কোনো বোন যেন ঝরে নাপরে। যেন কারো অকাল মৃত্যু না হয়। সর্বোপরি সবাইকে এটা অনুভব করতে হবে। না হলে বাল্যবিয়ে মুক্ত দেশ গড়া সম্ভব না। শুধু ভাষণ, বক্তব্য বা কথায় না, সবাই যেন সত্যিই বাল্যবিয়েকে না বলে সে জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলব।

মাহবুবা তাবাস্সুম ইমা: ফেনীর মেয়ে মাহবুবা তাবাস্সুম ইমা। নিজস্ব চেষ্টা ও প্রশাসনের সহযোগিতায় ১৮টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন। স্কুলে থাকতেই বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতেন।

ইমা জানান, স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক থেকে কাজ শুরু করি। যখন দেখি যে আমার মতো অনেক কিশোরী বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করছে। আমাদেরই একজন স্বর্ণ কিশোরী শারমিন আক্তার যে কিনা নিজের বিয়ে প্রতিরোধ করে। তাকে আমেরিকা থেকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। সেই থেকে তাকে দেখে আমি নিজেও প্রতিজ্ঞা করি যাতে অল্প বয়সে আমার জেলার কাউকে বাল্যবিয়ের মুখোমুখি হতে না হয়। নিজে যতটুকু পেরেছি সরাসরি গিয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছি। এছাড়া ফেনী জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়েও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছি। এ পর্যন্ত সরাসরি ৩টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছি, আর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ১৫টার মতো প্রতিরোধ করেছি।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, ৯ মার্চ, ২০২২
এসএইচডি/এমএমজেড 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।