ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ মে ২০২৪, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

তাদের বেঁচে ফেরা যেন গল্প 

এস.এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২২
তাদের বেঁচে ফেরা যেন গল্প 

বাগেরহাট: ঝড় জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও গভীর সাগরে মাছ ধরতে যান উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেরা। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি থেকে মাছ আহরণ করেন তারা।

১০-১৫ দিনের জন্য মাছ আহরণে গভীর সাগরে যান তারা। প্রতিবারই অসীম সম্ভাবনা আর অজানা ভয় ও শঙ্কা নিয়ে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়। বেশিরভাগ সময় ভালোভাবে ফিরলেও, মাঝে মধ্যে সাগরের মধ্যে বড় বিপদে পড়তে হয় তাদের।  

সম্প্রতি ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে গভীর বঙ্গোপসাগরে বিপদে পড়েছিলেন উপকূলীয় জেলা ভোলার ২০ জেলে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনে হাতের আংটি, তাবিজ ও ঘড়ি সাগরে ফেলে দিয়েছিলেন তারা। টানা ১৮ দিন সাগরে ভাসার পরে ভারতের উড়িষ্যায় পৌঁছান জেলেরা। ১৩ দিন নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাখার পরে জেলেদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয় ভারতীয় কোস্টগার্ড। সেখান থেকে আরও চার দিন পরে বাড়ি পৌঁছান জেলেরা। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আনন্দিত জেলেরা।

ইঞ্জিন বিকল হওয়া ট্রলার ‘এফ বি আল্লার দান’ এর মাঝি ৬০ বছর বয়সী মো. আবু বকর বলেন, ৪৫ বছর ধরে সাগরে যাই। অনেকবার বিপদে পড়েছি আমি। কিন্তু এতো বড় বিপদে কোনোদিন পড়িনেই। আল্লাহর রহমাতে বেঁচে ফিরেছি। ’

এই বলে মোবাইলে কান্না জুড়ে দেন তিনি। কিভাবে বিপদ হলো এমন প্রশ্নের উত্তরে আবু বকর বলেন, ১৫ দিনের খাবার, পানি ও প্রয়োজনীয় বরফ নিয়ে ৭ ডিসেম্বর ভোরে ভোলার চরফ্যাশানের বেতুয়া ঘাট থেকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে ট্রলার ছাড়ি আমরা। ২৪ ঘণ্টা একটানা দক্ষিণের দিকে চালিয়ে, মাছ ধরা শুরু করি আমরা। দুই ধাপ মাছ ধরার পরে ৯ ডিসেম্বর বিকেলে আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন নষ্ট হয়, ঠিক করার জন্য নোঙর ফেলি। এর মধ্যে বাতাস ও ঢেউ বাড়তে থাকে। ঢেউ থেকে বাঁচতে সাগরের মধ্যে জাল ফেলি। সবাই মিলে একদিন চেষ্টা করেও ইঞ্জিন ঠিক করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে অন্যত্র যাওয়ার চেষ্টায় জাল উঠাতে চাই। ঢেউয়ের তোড়ে উঠাতে না পেরে জাল কেটে দেই আমরা।  

ইঞ্জিনের ট্রলার হওয়ায় কোনো পাল ছিল না আমাদের। শীত নিবারনের জন্য নেওয়া কম্বল ও খ্যাতা দিয়ে পাল টানাই। সঙ্গে বইঠা দিয়ে বাইতে থাকি। এভাবে ৫ দিন চলার পরেও কোন কূলকিনারা পাই না। কোনো মাছধরা ট্রলার বা জাহাজের দেখাও নেই। অন্যদিকে ১০ দিন হয়েছে বাড়ি থেকে আসছি। চাল, পানিসহ অন্যান্য খাবারও শেষের পথে। কি করব কিভাবে বাঁচব এতোগুলো মানুষ আমরা।  

দুই হাজার বাম (এক বাম সমান চার হাত) রশি ফেলেও সাগরের তলা পাই না। তখন সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম। বেঁচে ফিরতে পারব কিনা, পরিবার পরিজনের সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। এই ভেবে কান্না জুড়ে দিল কয়েকজন। একজন আরেক জনকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে, একটু পরে আবার কেঁদে ওঠেন অন্য কেউ। এভাবে সাগরে ভাসতে ভাসতে আরও পাঁচদিন পার হয়ে গেল আমাদের। এরই মধ্যে সবজি, কাঁচা বাজার ও খাবার পানি শেষ। ৫০ কেজির বস্তা থেকে দুই দিনে প্রায় ১০-১২ কেজি খেয়ে ফেলেছি। তখন বরফ গলা পানি দিয়ে দিনে মাত্র দুই কেজি চাল রান্না শুরু করলাম। সকালে ফ্যান (ভাতের মাড়) আর রাতে লবন-ভাত ভাগ করে খেতাম। গভীর সাগরে ট্রলার ভাসছে, আর মৃত্যুর চিন্তাও বাড়ছে। সবাই মিলে আল্লাহকে ডাকি, যদি কেউ আমাদের উদ্ধার করে। এক পর্যায়ে ১৭ দিনের সময়, ২৪ ডিসেম্বর মনে হয় আর বাঁচব না। সবাই-সবার কাছে ক্ষমা চাই। আল্লাহ রসুলের নাম ডাকি। হাতে থাকা আংটি, তাবিজ ও মাজার তাগি (কালো রংয়ের মোটা সুতা) ফেলে দেই সাগরে। ছোট বেলায় শুনেছি মরার পরে এসব রাখতে হয় না।  

ওইদিনই আমাদের মধ্যে মাঝি নুর ইসলাম, মো. বসর ও মো. আবু জাহের অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারা মারা গেলে কি বলে সাগরে ফেলে দেওয়া হবে এই চিন্তাও করছিলাম আমরা। ওরা তিনজন মনের কথা খুলে বলছিল আমাদের। একদিন পরে ওরা সুস্থ হয়ে যায় আল্লাহর রহমতে।

এর মধ্যে আমাদের ট্রলারেও অনেক পানি উঠে যায়। ওইদিন বিকেল চারটার দিকে প্রবল গতির একটি স্রোত আসে। স্রোতের সঙ্গে আমরা ভাসতে থাকি। কান্নার রোল পড়ে যায় ট্রলারে। তখনও জানিনা এই স্রোত আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বাঁচবো কী মরবো! কয়েক ঘণ্টা পরে ট্রলারের পাটাতনের তক্তা খুলে আমরাও স্রোতের অনুকূলে বৈঠা বাওয়া শুরু করি। এভাবে ২৪ ঘণ্টা পরে স্রোতটি থেমে যায়, রশি ফেলে দেখি ৭৮ বাম পানি। আবারও পাঁচটি বৈঠা দিয়ে একই দিকে বাইতে শুরু করি। একদিন পরে অর্থ্যাৎ ২৬ ডিসেম্বর রশি দিয়া দেখি ১৭ বাম পানি। ক্ষুদার্থ শরীর ও মৃত্যু ভয়ে ক্লান্ত মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হল। তবে বৈঠা আর চলছিল না। নোঙর ফেললাম। অনেক কান্নাকাটির পরে ভারতীয় একটি ট্রলার আমাদের কাছে এলো। খুলে বললাম বিপদের কথা, সহযোগিতার হাত না বাড়ালেও পূর্ব দিকে গেলে সাগরের কিনারা পাওয়া যাবে বলে পরামর্শ দিল তারা।


 
সবাই মিলে বৈঠা বাইয়ে একদিন পরে কূলের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন আমাদের কথায় দয়া দেখিয়ে, ভারতীয় একটি মাছধরা বোট আমাদের টেনে কূলে পৌঁছে দেয়। জানতে পারি ভারতের উড়িষ্যা এলাকার পারাদ্বীপ বন্দর এটা। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার আনন্দে সবাই-সবাইকে ধরে কান্নাকাটি করছিলাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমরা কূলে পৌঁছাইছি। পরামর্শ করে ভারতীয় কোস্টগার্ডের কাছে সবকিছু খুলে বলি। বোট তল্লাশি করে এবং আমাদের সঙ্গে কথা বলে কোনো প্রকার খারাপ কিছু না পাওয়ায়, আমাদের খুব সমীহ করতে শুরু করল কোস্টগার্ড সদস্যরা।
 
কোস্টগার্ডের স্যারেরা আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন ঠিক করার চেষ্টাও করেছে কিন্তু পারেনি। ভারতীয় কোস্টগার্ডের তত্ত্বাবধায়নে থাকার সময়, আমাদের কোনো কষ্ট হয়নি। প্রায় ১৩ দিন ভারতীয় কোস্টগার্ডের তত্ত্বাবধায়নে থাকার পরে বাংলাদেশের কোস্টগার্ডের হাতে জেলেদের তুলে দেয় তারা। ১০ জানুয়ারি দুপুরে ট্রলার মালিক আলী হোসেনের প্রতিনিধির কাছে জেলেদের হস্তান্তর করে মোংলা কোস্টগার্ড। এরপর তিনদিন ট্রলার চালিয়ে ১৩ জানুয়ারি বাড়ি পৌঁছায় জেলেরা।

ট্রলারে থাকা ২২ বছর বয়সী জেলে সালাহ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘মাত্র ৪ বছর বয়সী ছেলে রেখে সাগরে গেছিলাম। ছেলেটা আমার সঙ্গে আসার জন্য জড়িয়ে ধরে কান্না করছিল। সাগরে যখন ভাসতে ছিলাম, তখন ছেলেটার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। বার বার আল্লাহকে বলছিলাম একবার মাত্র ছেলেটাকে দেখার সুযোগ করে দেও। আল্লাহ আমাদের সবার মনের আশা পূরণ করছেন। প্রত্যেকে আল্লাহর ওয়াস্তে একটি খাসি জবাই করে এতিম মিসকিনদের খাওয়ায়ে দেওয়ার ওয়াদা করেছি। ’

ট্রলার মালিক আলী হোসেন বলেন, ‘একদিকে প্রায় কোটি টাকা দামের ট্রলার, অন্যদিকে ২০টি তাজা প্রাণের চিন্তায় কয়েকবার হার্ট ফেল করার মতো অবস্থা হয়েছে আমার। এমন অবস্থায় ৩০ ডিসেম্বর ভারতীয় কোস্টগার্ডের ফোন পেয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি আমরা। সবার পরিবারকে জানাই। তবে এর মধ্যে কিছু দুষ্ট চক্র জেলেদের ডাহাতে (ডাকাত) ধরে নিয়েছে বলে আমাদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করেছিল। কিছু টাকা একটি পরিবারের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণও নিয়েছে তারা। তবে প্রশাসনের সহযোগিতায় অন্য জেলেদের কাছ থেকে আর টাকা নিতে পারেনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।