ঢাকা, শনিবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৭ জুন ২০২৫, ১০ জিলহজ ১৪৪৬

জাতীয়

ক্রেতা থাকলেও গরু সংকটে কমলাপুর পশুর হাট

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:১৭, জুন ৬, ২০২৫
ক্রেতা থাকলেও গরু সংকটে কমলাপুর পশুর হাট

ঢাকা: আগামীকাল ঈদুল আজহা। শেষ সময়ে তাই রাজধানীর হাটগুলোতে চলছে কোরবানির পশু বেচাকেনা।

শেষ মুহূর্তে একটু কম দামে ভালো গরু কিনতে পরিবারসহ আত্মীয় স্বজন নিয়ে পশুর হাটে এসেছেন অনেকেই। ফলে ক্রেতার চাপে গরুর সংকট দেখা দিয়েছে কমলাপুর হাটে। ছোট ও মাঝারি পশু রাখার নির্ধারিত জায়গাগুলো বেশির ভাগ ফাঁকা দেখা গেছে। ফলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে এসে কাঙ্ক্ষিত পশু কিনতে পারছেন না অনেক ক্রেতাই।

ব্যাপারিরা বলছেন, নতুন করে পশু না এলে বিকেল নাগাদ খালি হাতে ফিরতে হবে ক্রেতাদের। এ বছর এক থেকে দুই লাখ টাকা দামের গরুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বড় গরু তেমন কেউ ধরছে না। ক্রেতা আসে সেলফি তুলে, দাম জিজ্ঞাসা করে চলে যান। বড় গরুগুলো কম দামে ছাড়লে লোকসান গুনতে হবে। তাই শেষ সময় পর্যন্ত তারা দেখতে চান। অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, এখন আর দেখাদেখির সময় নেই। পছন্দ হলে বাজেটের আশেপাশের দামে কিনছেন তারা।

শুক্রবার (৬ জুন) সকালে রাজধানীর কমলাপুর হাট ঘুরে দেখা যায়, পশুর হাটটি সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টার থেকে আশেপাশের এলাকা ছাড়িয়ে গেছে। আরেক দিকে মুগদা বিশ্বরোড থেকে গোপীবাগ পর্যন্ত সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে এ হাটে আজকে ক্রেতা থাকলেও গরুর সংকট দেখা দিয়েছে। ছোট-মাঝারি পশু রাখার নির্ধারিত জায়গাগুলো সকালেই খালি। ফলে ক্রেতারা কিনতে পারছেন না কাঙ্ক্ষিত পশু। পশু যাও মিলছে, সেগুলোর দাম নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে দুই এক হাজার টাকা কম কিংবা বেশি-পছন্দসই পশু পেলেই কিনে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই। এছাড়া দামে না মেলায়, বেঁকে বসা ব্যাপারিকে বোঝাচ্ছেন কেউ কেউ! বিক্রেতাদের দিক থেকে আরও একটু লাভের আশায় এখনো দর-দাম, দড়ি টানাটানি চলছেই।

প্রসঙ্গত, এ বছর ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় এবার ১৯টি অস্থায়ী পশুর হাট বসেছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে বসবে ১০টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বসবে নয়টি পশুর হাট। এছাড়াও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় স্থায়ী গাবতলী হাট এবং দক্ষিণ সিটির আওতায় স্থায়ী সারুলিয়া হাটেও কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় হয়। এ হিসেবে এ বছর ঈদুল আজহায় রাজধানী ঢাকায় কোরবানির পশু কেনা-বেচার জন্য মোট ২১টি স্থানে হাট বসছে। ঈদুল আজহার দিনসহ মোট পাঁচ দিন নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু ক্রয় ও বিক্রয় হচ্ছে।

কমলাপুর হাটে ১২০০ কেজির গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মো. সোহান।  তিনি বাংলানিউজকে বলেন, চুয়াডাঙার আলমডাঙ্গা থানার এরশাদপুর গ্রাম থেকে ছোট মাঝারি ও বড় গরু মিলিয়ে ১৯টি গরু এনেছি।  সব বিক্রি হলেও আমার সবচেয়ে বড় গরুটি বিক্রি হয়নি এখন পর্যন্ত। দাম চেয়েছি সাত লাখ টাকা। পাঁচ লাখ টাকা না হলে বিক্রি করবো না। এ গরু আনা নেওয়া অনেক কষ্টের। বিক্রি করতে না পারলে বাড়ি নিয়ে যাবো। তবুও লসে বিক্রি করবো না।

তিনি আরও বলেন, ঢাকাতে অনেক বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম। এখানে ভালো দাম পাবো। কিন্তু এখন দেখি উল্টো। ঢাকাতে বড় গরুর চাহিদা নেই, ছোট ও মাঝারি গরু বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ বছর বড় কোনো ক্রেতা হাটে আসেনি যে, আমার বড় গরুটা নিয়ে যাবে। দামতো বেশি না। এ গরুটার পেছনে আমার গত চার বছরে সাত লাখ টাকা খরচ আছে। তারপরও বলেছি পাঁচ লাখ টাকা হলে ছেড়ে দেবো। কারণ এটা পালতে পারছি না। এর পেছনে আমার অনেক খরচ হচ্ছে। যদি হাটে বিক্রি করতে না পারি বাড়ি নিয়ে কষাইকে দিয়ে দেবো।  

নাটোর থেকে মো. দুলাল হোসেন নামে এক ব্যাপারি ২২টি গরু নিয়ে আসছেন কমলাপুর হাটে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর কোনো ধরনের ঝুট ঝামেলায় পড়তে হয়নি। একটা গরু বাদে সব বিক্রি হয়েছে। আমি ছোট গরু এনেছি। যেকয়টি গরু বিক্রি করেছি সেগুলো ৮০ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যেই। বড় গরু আনিনি, কারণ সেগুলোর খরচ বেশি, দাম বেশি কারণে ক্রেতারা নিতে চায় না। বেচা বিক্রি ভালো হয়েছে। একটা বিক্রি করতে পারলে বাড়ি চলে যাবো।

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার (৫ জুন) পর্যন্ত হাটে অনেক গরু ছিল। ভোর হতেই সব গরু বিক্রি হয়ে গেছে। হাটে এখন হাতে গোনা গরু আছে। সকাল থেকেই ক্রেতা আসছে দেখে গরু চলে যাচ্ছে। কারো পছন্দ হলে কিনছে। না হলে অন্য হাটে চলে যাচ্ছে। মোট কথা হাটে ক্রেতা আছে কিন্তু গরু নাই।  

মেহেরপুর থেকে ১৩টি গরু নিয়ে কমলাপুর পশুর হাটে আসেন মো. সমির উদ্দিন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি ছোট বড় মাঝারি সাইজের ১৩টি গরু এনেছি। সব বিক্রি হলেও বড় গরুটি বিক্রি করতে পারিনি। আমি এক লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে তিন লাখ ২৫ হাজার টাকার গরু বিক্রি করেছি। বড় গরুটা চার লাখ টাকা পেলে বিক্রি করবো। নইলে বাড়ি নিয়ে কসাইয়ের কাছে দিয়ে দেবো।  

তিনি বলেন, এ বছর গরুর দাম ভালো গেছে। যেগুলো ছোট ও মাঝারি সাইজের গরু। বড় গরু হলে কেউ ধরছে না। দাম শুনে চলে যায়। সামনে আর বড় গরু পালবো না। হাটে ক্রেতা থাকলে কি হবে বড় গরুর কোনো ক্রেতা নেই। সবাই ছোট ও মাঝারি সাইজের গরু খোঁজে।

মাদারীপুরের কালকিনি থানার সাহেব রামপুর গ্রামের খামারি মো. রিয়াজুল রহমান কমলাপুর হাটে এসেছেন ১০টি মাঝারি ও বড় গরু নিয়ে। দুটি গরু সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা করে বিক্রি করেছি। আর মাঝারিগুলো আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। এখনও তিনটি বড় গরু আছে। এগুলো চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকার মধ্যে দাম পেলে বিক্রি করবো। না হলে বাড়ি নিয়ে যাবো। লস করে তো আর গরু বিক্রি করা যাবে না। বাড়ি নিয়ে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করলে আমার লাভ হবে।

কমলাপুরে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে ১০টি খাসি নিয়ে এসেছেন জাহাঙ্গীর আলম। এর মধ্যে দুটি ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। সবচেয়ে ছোট খাসির দাম চাচ্ছেন ১৫ হাজার টাকা। বড় ২৫ কেজি ওজনের খাসিটি ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করবেন বলে জানান তিনি।

কমলাপুর হাট থেকে আক্তারুজামান স্বপন তিন লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে কোরবানির জন্য গরু কিনেছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এবারের গরুর দাম ভালো আছে। বাজারে কোনো কালোবাজারি নেই। কারো সঙ্গে রেষারেষি করে গরু কিনতে হয়নি। বাজারে এসেছি পছন্দ করেছি, দামে বনেছি পরে কিনেছি। তবে এবার বাজারে বড় ক্রেতা কম। কারণ সরকার পরিবর্তনের ফলে অনেকেই গাঁ ঢাকা দিয়ে আছেন। তারা কেউ বাজারে আসছেন না।

পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী কাজল মোল্লা কমলাপুর হাটে গরু কিনতে এসেছেন। তিনি বলেন, ধোলাইখাল হাট ও পোস্তগোলা হাট ঘুরে এসেছি সেখানে কোনো গরু পছন্দ হয়নি। হাট খালি হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার বৃষ্টির জন্য হাটে যাইনি। এখন কমলাপুরে এসে দেখি একই অবস্থা। আর ঘুরাঘুরি করা যাবে না। এখানেই কয়েকটা গরুর দাম-দর করেছি।

তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় দাম কিছুটা বেশি মনে হচ্ছে। পরিবারের জন্য মাঝারি সাইজের একটা দেশি গরু নিতে চাই। যতগুলো গরু দেখেছি, সবই দেখতে ভালো। তবে কিছু বিক্রেতা বেশি দাম চাচ্ছেন। তারপরও হাটে এসে নিজের হাতে গরু দেখে কিনে নেওয়ার আলাদা আনন্দ আছে।

কমলাপুর স্টেডিয়াম এলাকা থেকে তিন লাখ টাকা দিয়ে শাহীওয়াল জাতের একটি গরু কিনেছেন মুগদাপাড়ার বাসিন্দা নাজমুল হোসেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার তার গরু কেনা ভালো হয়েছে। তিন লাখ টাকার গরুতে ১০ মণের মতো মাংস হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। গরু কিনতে পারায় খুশি তিনি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কোরবানিযোগ্য মোট গবাদিপশুর সংখ্যা এক কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি যা গতবছরের চেয়ে চার লাখ ১১ হাজার ৯৪৪টি বেশি। এর মধ্যে ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২টি গরু-মহিষ, ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং দুই হাজার ৫৮১টি অন্যান্য প্রজাতির গবাদিপশু। কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে ঢাকা বিভাগে আট লাখ ৯৫ হাজার ৪৫৪টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ লাখ ৫৩ হাজার ১২৮টি, রাজশাহী বিভাগে ৪৫ লাখ ১১ হাজার ৬১৪টি, খুলনা বিভাগে ১৫ লাখ ১১ হাজার ৭০৮টি, বরিশাল বিভাগে চার লাখ ৯৩ হাজার ২০৬টি, সিলেট বিভাগে চার লাখ ১০ হাজার ২২৫টি, রংপুর বিভাগে ১৯ লাখ ৬২ হাজার ৯৫১টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ছয় লাখ ৯৮ হাজার ৪৭টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে। এ বছর কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা এক কোটি তিন লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। সে হিসেবে এ বছর ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে।

জিসিজি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।