ঢাকা, শুক্রবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৬ জুন ২০২৫, ০৯ জিলহজ ১৪৪৬

জাতীয়

বাজারে মাছ কেটেই চলে সংসার, হয়েছে সঞ্চয়ও

জি এম মুজিবুর, সিনিয়র ফটো করসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭:৪০, জুন ৫, ২০২৫
বাজারে মাছ কেটেই চলে সংসার, হয়েছে সঞ্চয়ও

প্রতিদিন ভোরে উঠে চলে যান মাছের বাজারে। হাতে থাকে ছুরি, বঠিসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী।

একটি প্লাস্টিকের টুলে বসে শুরু করেন মাছ কাটা। বাজারে তার খ্যাতি নেই, কেউ হয়তো তার নামও জানেন না—কিন্তু তার মাছ কাটার দক্ষতা জানে পুরো বাজার।

এক সময়ের অপ্রচলিত এই পেশায় তিনি জীবন সাজিয়েছেন নিজের মতো। পরিশ্রম আর সময়জ্ঞানকে পুঁজি করে তিনি নিজেকে লাখপতিও বানিয়েছেন। ব্যাংকে রয়েছে সঞ্চয়, করেছেন থাকার বাড়ি, সন্তানদেরও দিয়েছেন শিক্ষা।

এ সাফল্যের গল্প লাভলুর (৩৫)। বাড়ি পটুয়াখালী মির্জাগঞ্জে। থাকেন ঢাকার মিরপুর এলাকায়। ১৭ বছর ধরে মাছ কাটার কাজ করেন মিরপুর ৬ নম্বর বাজারে।

লাভলু বাংলানিউজকে বলেন, মাছ কাটার কাজ করে ১৭ বছরে অনেক টাকা পুঁজি করেছিলাম। ছোট বোন ক্যানসারে অসুস্থ হওয়ায় চার লাখ টাকা তার পেছনে খরচ করি। আরও চার লাখ টাকা ঋণ ছিলাম, সেটাও পরিশোধ করেছি। মা-বাবাসহ ছয় ভাই-বোনের সংসার, সেখানে যোগান দিয়েছি, সবার পেছনে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করেছি। সবকিছুই এই বাজারে মাছ কেটেই করেছি। এমনকি আমার কাছে নগদ দুই লাখ টাকা এখনো জমা আছে।

লাভলু বলেন, সৎ পথে থেকে পরিশ্রম করলে যত ছোট কাজ হোক না কেন সেখান থেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় বলে আমি মনে করি।

লাভলুর ভাষ্যে, ঢাকা শহরে পুরুষের পাশাপাশি নারীও নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। এজন্য কেউ আর ঘরে মাছ কাটতে সময় পান না, কাটতেও চান না। তাই যত মাছ, সব বাজার থেকে কেটে নিয়ে যেতে হয় চাকরিজীবী ক্রেতাদের। সেক্ষেত্রে আমরা যারা মাছ কাটি, এই খাতে সারা দেশে শহর অঞ্চলের প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে বলে আমি মনে করি।

রোজগার কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে প্রতিদিন যে টাকা কামাই করেছি খরচ বাদ দিয়েও এক-দেড় হাজার টাকা থাকতো, কোনো কোনো দিন দুই হাজার টাকাও থাকতো, এখন দিনে ৪-৫ শ’ টাকা সর্বোচ্চ আয় করা যায়। শুক্র ও শনিবারে হাজার-বারোশ’ টাকা ইনকাম করতে পারি।

লাভলু আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, আমার জীবনে একটা কষ্টের কথা, যখন আমার টাকা ছিল সবাইকে দিতে পেরেছি। তখন আমি কারও ভাই কারও মামা কারও খালু ছিলাম। এখন সেই পরিমাণে দিতে পারি না। তার জন্য পরিবার ও আপনজনদের ব্যবহারে মনে হয় আমি তাদের রক্তের কেউ না।

মিরপুর ৬ নম্বর কাঁচা বাজারে নিয়মিত মাছ কেনেন মোহাম্মদ হারুন (৪০)। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি প্রতি সপ্তাহে একবার বাজার করি। চাকরি করার কারণে প্রতিদিন বাজার করা সম্ভব হয় না। আমার স্ত্রীও চাকরি করেন। সেক্ষেত্রে আমাদের ঘরে মাছ কাটার মত সময় না থাকার কারণে বাজার থেকেই কেটে নিয়ে যেতে হয়। এদের থেকে অনেকদিন যাবত আমি মাছ কাটি। এরা খুব ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে কেটে দেয়। পয়সা বেশি লাগে না।

মাছ কাটার একটি দোকান চালান মোহাম্মদ আলী (৬০)। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৭৩ সালে বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসি, তারপর বাবা ৬ নম্বর বাজারে একটা মাছের দোকান দেন। আস্তে আস্তে বাবার দোকানে কাজ শিখি, তারপর আমারও মাছের দোকান হয়। একটা সময় পারিবারিক বিশেষ কারণে দুইটা দোকান আমাদের চলে যায়। পরে কী করব, বাবা এই মাছ কাটার কাজ শুরু করেন। আমিও অন্য দোকানে মাছ কাটার কাজ শুরু করি, তারপর এখন আমার ছেলেও ওই বাজারে মাছ কাটে, আমরা তিন পুরুষ এই কাজ করে আসছি।

মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার কাজের বয়স ৪০ বছর, পুঁটি মাছ থেকে শুরু করে ১০৫ কেজি ওজনের মাছ পর্যন্ত আমি নিজ হাতে কেটেছি, অনেক টাকা ইনকাম করেছি। এখন আর ইনকাম নেই, সব খরচ বাদ দিয়ে ৫-৬ শ’ টাকা থাকে, শুক্র ও শনিবারে হাজার-বারশ’ টাকা হয়, তাও নিজের দোকান দেখে।

জানা যায়, রাজধানীর কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ১ নম্বর, মিরপুর ১২ নম্বর, রজনীগন্ধা মার্কেট, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, গুলশান, বাড্ডা, বিশ্বরোড, উত্তরাসহ বিভিন্ন বাজারে এখন মাছ কাটার আলাদা খাত গড়ে উঠেছে, যেখানে শত শত লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে।

জিএমএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।