ঢাকা, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

পরিবেশের সহনশীলতার সঙ্গে বিদ্বেষপূর্ণ আচরণও তীব্রভাবে বেড়েছে: বাপা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৪
পরিবেশের সহনশীলতার সঙ্গে বিদ্বেষপূর্ণ আচরণও তীব্রভাবে বেড়েছে: বাপা ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকা: পরিবেশ ও প্রতিবেশের সহনশীলতার সঙ্গে বিদ্বেষপূর্ণ আচরণও তীব্রভাবে বেড়েছে। গরমের তীব্রতা কমাতে কেউ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ব্যবহার করছেন আবার কেউবা বঞ্চিত হচ্ছেন।

এই ধনী-দরিদ্র বা সামর্থ্যবান-অসামর্থ্যবানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের তীব্রতার কারণে তাপমাত্রা বাড়ার চেয়ে অনুভবের মাত্রা বেড়েছে। ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এভাবেই অর্ধ বিকলাঙ্গ একটি প্রজন্ম তৈরির যন্ত্রে পরিণত হয়েছে এই নগরী।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে ‘নগর তাপদাহের তীব্রতা: প্রেক্ষিত ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা একথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

লিখিত বক্তব্য পাঠকালে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, দেশের নগরগুলোয় তাপদাহ অনুভবের এই তীব্রতা বাড়ার অন্যতম মূল কারণ হল ভুল নগরদর্শন। ৯০ দশকের পর নগরগুলোয় অপরিকল্পিত, মানব বিচ্ছিন্ন এবং পরিবেশ বৈরী কর্মধারার মধ্য দিয়ে দ্রুতগতির নগরায়নের ধারার যে বিকাশ, আজকের এই নগরীগুলোর অভিঘাতসমূহ তারই প্রকাশ।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার বরাত দিয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, পৃথিবীর উষ্ণতম বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারে ২০২৪ সাল। জাতিসংঘের আবহাওয়া সংক্রান্ত বার্ষিক রিপোর্টে গত এক দশকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গড়ে প্রায় এক দশমিক ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বরাবরই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকির তালিকায় অন্যতম। পাশাপাশি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ‘এল নিনো’র প্রভাব, বাংলাদেশে চরমভাবাপন্ন পরিবেশ ও আবহাওয়ার সৃষ্টি করছে। এর ফলে ষড়ঋতুর এই দেশে ঋতু পরিবর্তনে অসঙ্গতি দেখা দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, দক্ষিণ দিকে থেকে আগত মৌসুমি বায়ুর দ্রুত আগমন ঘটছে। আবার অপরদিকে, উত্তর দিক থেকে আগত আন্তঃদেশীয় দূষিত ও উষ্ণ বায়ুর প্রবেশ ঘটছে দেশীয় আবহাওয়ায়। এছাড়া নদীর ওপর বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং নদী শাসন ও খনন ব্যবস্থাপনার অভাবে নদীমাতৃক এই দেশের নদীগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। এভাবে উত্তপ্ততার পরিধি বাড়ছে। এতে করে তাপমাত্রা সীমাহীন না হলেও তীব্র তাপদাহ অনুভূত হচ্ছে।

সবুজায়ন ও বনায়ন উজাড় হয়ে তাপমাত্রা বাড়ার আরেকটি অন্যতম কারণ উল্লেখ করে ইকবাল হাবিব বলেন, বাংলাদেশে বনজ সম্পদ ও বনভূমির অবক্ষয় ক্রমশ বাড়ছে, যা পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশে ভূখণ্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাব মতে, বাংলাদেশে বার্ষিক দুই দশমিক ছয় শতাংশ হারে বন উজাড় হয়েছে, যা বার্ষিক বৈশ্বিক গড় হারের প্রায় দ্বিগুণ। গত ১৭ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইট বিশ্লেষণী গবেষণায়, গত ২৮ বছরে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকা থেকেই প্রায় ৮৫ ভাগ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি এই সময়ে নির্মাণ এলাকা বা স্থাপনা বেড়েছে ৭৫ ভাগ অর্থাৎ সবুজ গাছপালা এবং জলাশয় ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে।

বায়ুপ্রবাহ এবং দূষণজনিত প্রেক্ষাপট তুলে ধরে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, দেশের নগরীগুলোয় ভবনগুলোর বিন্যস্ততায় পারস্পরিক দূরত্ব বা সেটব্যাকের মধ্য দিয়ে বাতাসের প্রবাহধারা নিশ্চিত করার যে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করা যায়নি বললে অত্যুক্তি হবে না। ঢাকার ক্ষেত্রে, বিভিন্ন সময়ে ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা’র অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবর্তন কিংবা তার ব্যত্যয় করে অননুমোদিত ভবন নির্মাণ তথ্য অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন কার্যক্রম প্রকারান্তরে অবস্থাকে আরও দুর্বিষহ করেছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ঢাকা মহানগরীতে অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যাই ৯৪ শতাংশেরও বেশি। এরমধ্যে অনুমোদন নেওয়ার পর ব্যত্যয়কারী বা পুরোপুরি আইন লঙ্ঘনকারীরাও রয়েছেন। ফলে, বাতাসের আনুভূমিক চলাচল সড়ক করিডোরের বাইরে নেই বললেই চলে। এভাবে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য নগরীগুলোয় বিভিন্ন এলাকাসমূহ উত্তপ্ত দ্বীপের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তাপীয় দ্বীপ বা হিট আইল্যান্ড' এ রূপান্তরিত হয়েছে।

২০২১ সালে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের যৌথভাবে পরিচালিত একটি গবেষণায় ঢাকার (বাড্ডা, গুলশান, মহাখালী, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, বাসাবো, বাবুবাজার, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, উত্তরা, মোহাম্মদিয়া হাউজিং, ফার্মগেটসহ ২৫টি স্থানকে ‘তপ্ত দ্বীপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৮ দাবি জানিয়েছে বাপা। এগুলো হলো:

১. বন ও বনভূমি সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তর/কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ, প্রণোদনা ও আইনভঙ্গকারীদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা।

২. সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে পথভ্রষ্ট সম্প্রসারণ উন্নয়নের নামে বসবাসযোগ্য নগর পরিবেশ ধ্বংসে যেভাবে সচেষ্ট, তা থেকে তাদেরকে সম্পূর্ণ নিবৃত করে কার্যকর সবুজায়ন নীতিমালার ভিত্তিতে সংরক্ষণ নিশ্চিত করে ভারসাম্যপূর্ণ এবং দেশজ বৃক্ষ রোপণ ও লালনের কর্মসূচি কার্যকর করার পাশাপাশি নগর বন সৃষ্টির ব্যাপক কর্মসূচি নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তি ও করপোরেট ভিত্তিক সবুজায়ন ও বনায়ন উদ্যোগকে প্রণোদিত এবং কখনও কখনও বিশেষভাবে উৎসাহিত করার প্রয়াস নিতে হবে।

৩. নগরব্যাপী বিদ্যমান পুকুর, খাল ও অন্যান্য জলাশয় পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণপূর্বক নগরীর বাসযোগ্যতা উন্নয়নে সমন্বিতভাবে নীল অন্তঃসংযোগ গড়ে তোলার পাশাপাশি নদীর সঙ্গে তাদের সংযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয় আশু উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি নগরীতে বিদ্যমান পুকুর, জলাধার ও পানি সংরক্ষণ উদ্যোগগুলোর ত্বরান্বিত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

৪. সমীক্ষানির্ভর নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রণোদনা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সাম্যতার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিতার নগরদর্শন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও সংস্থাগুলোকে নিয়ে আশু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। ব্যক্তি পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি এবং জনমানুষকে নিয়ে প্রতিটি বাড়িতে তাপদাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সামর্থ্যের জায়গাটি কাজে লাগানো প্রয়োজন।

৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সঠিক বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে বিধায় এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।

৬. যত্রতত্র নিয়ন্ত্রিত কাচের ভবনের ‘আত্মঘাতী সংস্কৃতি’র বিপরীতে প্রকৃতির নির্ভরতায় জীবন আচরণ নিশ্চিতের ‘নগর দর্শন’ ভিত্তিক বিনির্মাণ নিশ্চিতে অনতিবিলম্বে ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় যথোপযুক্ত শুদ্ধিকরণের উদ্যোগ প্রয়োজন। যদিও রাজউক তাড়াহুড়া করে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করা ছাড়া সেই সুযোগকেও হত্যা করার চেষ্টা করছে। আশু উদ্যোগের মাধ্যমে তা প্রতিহত ও যথাযথ করা প্রয়োজন।

৭. নগরীতে বায়ু ও গ্যাসীয় দূষণের প্রধান প্রধান নিয়ামকসমূহ যেমন, অনুপোযোগী যানবাহন চলাচল, নির্মাণ কার্যক্রম ও মালামালের পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণজনিত দূষণ, ইটভাটাজনিত দূষণ, ময়লার ভাগাড়, কারখানার নির্গত ধোঁয়াসহ অন্যান্য বায়ু দূষণকারী কার্যক্রম রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কার্যকরী ও দৃষ্টান্তমূলক দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া। সরকারি-বেসরকারি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠান দিয়ে গৃহীত প্রকল্পের আওতায় নগর বায়ু ও বর্জ্য দূষণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার অভিঘাতের বিরুদ্ধে অভিযোজন ও ভারসাম্য নিশ্চিতের কর্মসূচিগুলো সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিতকরণের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করে তোলা জরুরি।

৮. সামগ্রিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে পরিবেশবাদী, পেশাজীবীসহ সবার সম্মিলিত ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টায় ২০২৩ সালে উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্য একটি সবুজায়ন নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। ইউএসএইড, বন অধিদপ্তর এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো মিলে বৃক্ষশুমারী করেছে। দেশব্যাপী সুপরিকল্পিত নগর সবুজায়ন নীতিমালা ভিত্তিক বাস্তবায়ন কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়াই সমিচীন।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন বাপার সভাপতি ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শহীদুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মিহির লাল সাহা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম, বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৪
ইএসএস/এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।