জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বিচার বিভাগের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিলেন বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
গত এক বছরের এ রোডম্যাপের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সে বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেন।
ওই অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, বিচারপতি, বিচার বিভাগ সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানসহ সারাদেশ থেকে আসা জেলা আদালতের বিচারকরা উপস্থিত ছিলেন।
ওই অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ তুলে ধরেন। এ ছাড়া রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অর্থপূর্ণ সংস্কার নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার রূপরেখা ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন।
২১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। বিগত এক বছরে প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট জানায়, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্রীকরণ নিশ্চিতকরণে গত ২৭ অক্টোবর পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এর মধ্যে গত ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগ একটি রিটে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের জন্য সরকারকে নির্দেশনা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো প্রস্তুতকরণে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের সেবার মানোন্নয়নে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো যথাসম্ভবরূপে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতি মাসে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে মনিটরিং সভা নিয়মিতভাবে আয়োজিত হচ্ছে।
গত ২ জানুয়ারি থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কোম্পানি সংক্রান্ত একটি বেঞ্চে সম্পূর্ণ কাগজমুক্ত বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করা হয়েছে। পরে গত ২০ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের অপর একটি কোম্পানি বেঞ্চে কাগজমুক্ত বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বেঞ্চগুলোতেও কাগজমুক্ত কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা প্রধান বিচারপতি রয়েছে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট প্রধান বিচারপতির নির্দেশে রেজিস্ট্রার জেনারেল একটি বিজ্ঞপ্তি দেন। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আদালতে উপস্থিত আসামিদের কেউ যেন আইনগত সহায়তা বঞ্চিত না থাকেন তা নিশ্চিত করতে অধস্তন আদালত/ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকলে উক্ত আসামির জন্য লিগ্যাল এইডের আইনজীবী প্যানেল থেকে আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া আদালতে উপস্থিত কোনো আসামির পক্ষে আইনজীবী নিযুক্ত থাকলে উক্ত আইনজীবী যেন নির্বিঘ্নে ও বাধাহীনভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতে প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা প্রণয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ এবং সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৭ রহিত করে গত ২৮ জুলাই বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়।
প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা মোতাবেক দেওয়ানী ও ফৌজদারি এখতিয়ার অনুসারে পৃথক আদালত স্থাপনে একটি পত্র গত ২১ এপ্রিল আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রধান বিচারপতির এই উদ্যোগে ফলে গত ১৮ সেপ্টেম্বর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৪ থেকে দেশের প্রতিটি জেলায় পৃথক দায়রা বিভাগ পুনর্গঠন করা সংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিসহ বিচার সেবায় বিচারপ্রার্থী জনগণের অভিগম্যতা বৃদ্ধিতে প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতের বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ইতোমধ্যে জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ে ১৯১টি পদসহ মোট ২৩২টি পদ সৃজিত হয়েছে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর কারণে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। গত ২০ অক্টোবর আপিল বিভাগ এ বিষয়ে রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করলে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয়। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যবিশিষ্ট সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আসা কোনো বিচারপ্রার্থী বা সেবাগ্রহীতা সেবা গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে সেবাগ্রহীতাকে সহায়তা করতে একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়। ওই হেল্প লাইন স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় হেল্প লাইনটি চালু করা হয়। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট হেল্প লাইনে সারা দেশ থেকে আইনি পরামর্শ, মামলা–সম্পর্কিত তথ্য ও অভিযোগ দাখিল-সংক্রান্ত ৩ হাজার ৭২টি কল এসেছে। এর মধ্যে আইনি পরামর্শ পেতে ১ হাজার ৬৬৮টি কল এসেছিল। বিভিন্ন মামলার তথ্য জানতে এসেছিল ১ হাজার ১৫৭টি কল।
গত ১৪ মে প্রধান বিচারপতি দেশের সকল অধস্তন আদালত/ ট্রাইব্যুনালে বিচারিক সেবা প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা ও নানাবিধ অনিয়ম দূরীকরণের উদ্দেশে দেশের ৬৪টি জেলায় ও আটটি মহানগর এলাকায় হেল্পলাইন চালুর ঘোষণা দেন। ওই হেল্পলাইন চালু করতে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে দেশের প্রত্যেক জেলা জজশিপের জেলা ও দায়রা জজ বরাবর একটি সিমকার্ডসহ মোবাইল ফোন সরবরাহ করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং এ লক্ষ্যে তিনি গত ৬ আগস্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি এস এম এমদাদুল হককে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন এর সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেন। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে গত ১৩ আগস্ট অধস্তন আদালতের বিচারকগণের ৩০ শতাংশ বিচারিক ভাতা বিদ্যমান পে-স্কেল থেকে প্রদান সংক্রান্ত একটি পত্র আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, যা বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
গত ১২ ডিসেম্বর বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের অনুকূলে সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণীত হয়।
গত ৭ জানুয়ারি সংস্কারকৃত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ভবন ও এজলাস কক্ষের উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি।
ইএস/আরবি