ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ইচ্ছেঘুড়ি

মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী | প্রিসিলা রাজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৯
মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী | প্রিসিলা রাজ

আজ তোমাদের একজন অসমসাহসী মানুষের কথা শোনাব যিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে চরম অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তাঁকে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই শিল্পচর্চা করে গেছেন তিনি। প্রখ্যাত ভাস্কর হিসাবে এখন মানুষ তাঁকে একনামে চেনে। এই লেখার শিরোনামে তাঁর নামটি তোমরা ইতোমধ্যে জেনে গেছ, তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। 

পরীরানীর বাড়িতে শৈশব
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জন্ম আজ থেকে একাত্তর বছর আগে, ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। খুলনা শহরের নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম হয়েছিল।

তাঁর বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক ছিলেন খুলনার দৌলতপুরে কমার্স কলেজের শিক্ষক আর মা রওশন আরা গৃহিণী। মা অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। মানুষের অধিকার নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেন তাঁদের নানাভাবে সাহায্য করতেন তিনি। মায়ের এই গুণ ফেরদৌসীর খুব ভাল লাগতো। এজন্য মায়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা যেন আরও গভীর হয়েছিল।

এগারো ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ফেরদৌসী। শৈশবের বেশ কয়েকটা বছর তাঁর নানাবাড়িতে কেটেছিল। বাড়িটি ছিল তাঁর দারুণ পছন্দের। বাড়ির নামটাও ছিল একইরকম প্রিয়। বাড়িটার নাম ছিল ‘ফেয়ারি কুইন’ যার অর্থ ‘পরীদের রানী’। সত্যি, সেই বাড়িতে রাজকুমারীর মতোই হাসি-আনন্দে দিন কেটেছিল ছোট্ট ফেরদৌসীর। বাড়িটাতে সবসময় একটা উৎসবের আমেজ, একটা মুখরতা যেন লেগে থাকতো। তাঁর নিজের কথায়, “এই ঘরে হয়ত ক্যারম খেলা চলছে, ওই ঘরে কেউ লিখছে, ওই ঘরে কবিতা আবৃত্তি চলছে, আরেক ঘরে বোনদের মধ্যে পুতুল খেলা নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি চলছে। ”

প্রিয় নানা, শের-এ-বাংলা ও জাহানারা ইমামের স্মৃতি
ফেরদৌসীর নানা আবদুল হাকিম ছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ। তিনি আইনজীবীও ছিলেন। নানার সঙ্গে দারুণ ভাব ছিল ফেরদৌসীর। তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষ। তার কাছে সব ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষের ছিল সমান কদর। ‘প্রিয়ভাষিণী’ নামটি তাঁরই রাখা। ছোট্ট ফেরদৌসীকে কোলে নিয়ে নানা মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের মতো বড় বড় কবিদের লেখা থেকে আবৃত্তি করে শোনাতেন। নানার সান্নিধ্যে থেকেই হয়তো ছোট্ট ফেরদৌসীর মধ্যে সাহিত্যের প্রতি দুর্বলতা জন্মেছিল। আরেকটু বড় হয়ে যখন বই হাতে পেলেন তখন বই পড়ার প্রতি গাঢ় ভালোবাসা তৈরি হলো। বইপোকা বলে তাঁর নাম রটে গেল।

১৯৫৪ সালে নানা আবদুল হাকিম ঢাকায় চলে এলেন। সে বছর তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবারও এলো। এলো নাতনী ফেরদৌসীও। পরিবারটি এসে উঠলো পুরানো ঢাকার কেএম দাস লেনের এক বাসায়। ফেরদৌসীকে ভর্তি করা হলো কাছেই নারী শিক্ষা মন্দির নামের একটি বিদ্যালয়ে। তাঁদের বাসার কাছেই থাকতেন বিখ্যাত নেতা শের-এ বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক। খালার হাত ধরে ফেরদৌসী যেতো শের-এ বাংলার বাসায়। বিরাট মানুষটিকে দেখলেই ফেরদৌসীর ভয় লাগতো। শের-এ বাংলা ব্যাপারটি বুঝেই যেন তাকে আরও ভয় দেখাতে চাইতেন। এরকম বেশ কয়েকবার হওয়ার পর ফেরদৌসীর ভয় গেল কেটে। তারপর ভয় পেতে যেন মজাই লাগতোত ছোট মেয়েটির। বিরাট বুড়ো মানুষটি তাকে ভয় দেখাবেন এই মজা পেতেই তিনি তখন খালার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে সেই বাসায় যেতেন। বড় হয়েই কেবল বুঝতে পেরেছিলেন শের-এ বাংলা কতো বড় মানুষ ছিলেন।  

আরেকটু বড় হয়ে ফেরদৌসী সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। সেসময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন জাহানারা ইমাম। পরবর্তীকালে তিনি ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম’ নামে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন, কারণ তাঁর ছেলে শাফী ইমাম রুমী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। প্রধান শিক্ষিকা জাহানারা ইমামকে ফেরদৌসীর দারুণ পছন্দ হলো। ভাস্কর হিসাবে যখন তাঁর খ্যাতি হলো তখন এক সাক্ষাৎকারে ফেরদৌসী বলেছিলেন, ‘আপাকে আমার এতো পছন্দ ছিল যে প্রতিদিন তাঁকে দেখবো বলেই স্কুলে আসতাম। একদিনও স্কুল কামাই দিতাম না। প্রতিদিন স্কুল উপস্থিতির জন্য বছরশেষে আমাকে পুরস্কারও দেওয়া হলো। কেউ তো তখন জানতো না যে জাহানারা আপাকে দেখার জন্যই আমি প্রতিদিন স্কুলে যেতাম!’

কিশোরী ফেরদৌসীর ষোড়শ সমস্যা
ঢাকায় কিছুদিন থাকার পর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে আবার খুলনায় ফিরে যেতে হয়। সেখানে তিনি পাইওনিয়ার গার্লস স্কুলে ভর্তি হলেন। এখান থেকেই মেট্রিক পাশ করেন তিনি। সেসময় এসএসসি পরীক্ষাকে মেট্রিক পরীক্ষা বলা হতো। তাঁর বয়স তখন মাত্র পনেরো কি সাড়ে পনেরো। এসময় একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেললেন তিনি। একটি ছেলেকে তাঁর খুব পছন্দ হলো এবং তাঁকে তিনি বিয়ে করে ফেললেন। বিয়েতে তাঁর পরিবারের কারোরই মত ছিল না। এর ফলে নানাবাড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটাই প্রায় ছিন্ন হয়ে গেল।

বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই ফেরদৌসী বুঝলেন খুব বড় ভুল করে ফেলেছেন তিনি। অনেক পরে, যখন ভাস্কর হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন তখন এক সাক্ষাৎকারে জীবনের এই ভুল সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি আসলে বাড়ির শাসন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। তাঁর পরিবারের বড়রা বিশেষ করে বাবা-মা, খালা-মামারা তাঁকে আদর যেমন করতেন তেমনি কড়া শাসনেও রাখতেন। শাসনের কড়াকাড়িটা তাঁর একদম পছন্দ ছিল না। তিনি ভাবতেন, বিয়ে হলে তিনি স্বাধীন হবেন। কেউ তাঁকে শাসন করতে পারবে না। তিনি মামী হবেন, চাচী হবেন, নানী হবেন। মামী-চাচীদের তো কেউ শাসন করে না, তাই তাঁকেও কেউ শাসন করবে না, এরকমই মনে হতো তাঁর।  

কিশোরবেলার এই ভুলটা যে তিনি একাই করেছিলেন তা নয়। চারপাশে তাকালে তুমি দেখবে কিশোরবেলায় আবেগের বশে ভুলঠিক বিবেচনা না করে অনেক মেয়েই বিয়ে করে ফেলে। ফেরদৌসী কিশোরবেলার এই সমস্যার নাম দিয়েছেন ‘ষোড়শ সমস্যা’। ‘ষোড়শ’ কথাটির অর্থ ষোলো। শুধু ষোলো বছরেই যে মানুষ এই ভুল করে তা নয়, আগেও করতে পারে। এই বিখ্যাত ভাস্কর বলেছেন, ‘ছেলেমেয়েরা যাতে এই ভুল না করে সেজন্য বাবা-মায়ের ও পরিবারের সচেতন থাকা দরকার। সন্তানদের নিয়মের মধ্যে রাখতে হবে, ভুলঠিক চেনার শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে তাদের আবার অতিরিক্ত কড়া শাসন করাও উচিত নয়। ’

ফেরদৌসীর বিয়ে হয়েছিল অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে। পরিবারের খরচ মেটাতে তাই বিয়ের পরই তাঁকে চাকরি নিতে হলো। পড়াশোনা কম তাই চাকরিও হলো খুব অল্প বেতনে। দেখতে দেখতে তিনটি ছেলেও হলো তাঁর। একদিকে ছেলেদের মানুষ করা আর ঘরের কাজ, অন্যদিকে চাকরি, অল্প বয়সের মেয়েটিকে প্রতিদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হতো। কিন্তু তারপরও পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছায় খুলনা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হলেন। পাশও করে গেলেন। শিল্পচর্চা তাঁর তখনও শুরু হয়নি। দেখতে দেখতে মুক্তিযুদ্ধ এসে গেল। আর তাঁর জীবনটাও বদলে গেল বরাবরের মতো।

মুক্তিযুদ্ধের সাহসী সেনানী
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী খুলনার একটি পাটকলে কাজ করতেন। তাঁর ভাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। অক্টোবর মাসে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারেরা ফেরদৌসীকে ধরে নিয়ে যায় এবং তাঁর ভাই সম্পর্কে জানতে দিনের পর দিন নির্মম নির্যাতন চালায়। বহু কষ্টে পাকবাহিনীর কবল থেকে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তাঁর জীবনে শান্তি ফিরে এলো না কারণ, তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন। পাটকলের চাকরিটাও চলে গিয়েছিল। ফলে ছোট ছোট তিনটি ছেলেকে নিয়ে ফেরদৌসীর আবার সংগ্রাম শুরু হলো।  

শান্তির খোঁজে শিল্পচর্চা
তিন সন্তানকে নিয়ে জীবন সংগ্রামের শুরুর দিকে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মানুষের কাছে সাহায্য পাননি। বরং তাঁকে অনেক অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। চারপাশের মানুষের খারাপ ব্যবহারের কারণে তিনি সবার থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিলেন। অনেকটা একা হয়ে গেলেন। আর অশান্তির এই পরিবেশটাই যেন তাঁকে ধীরে ধীরে শিল্পচর্চার দিকে ঠেলে দিলো। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘সেই একাকিত্বের মধ্যে যে জিনিসটি পড়ে থাকে সকলের দৃষ্টির অন্তরালে, সকল তুচ্ছের আড়ালে পড়ে থাকে যে জিনিসগুলো, সেগুলোর প্রতি আমি আকৃষ্ট হলাম। আমার যেন মনে হলো ওইসব পরিত্যক্ত জিনিসগুলো আমার মতোই পরিত্যক্ত একজন মানুষ। সেগুলোকে তুলে এনে একটা করে ফর্ম সৃষ্টি করে, দেখে যে আনন্দ সে আনন্দ নিয়েই আমার বেঁচে থাকা। ’ কত গভীর কষ্ট পেয়েই না ফেরদৌসী একথাগুলো বলেছিলেন। আবার সেই কষ্ট আর একাকিত্ব থেকেই তিনি শিল্পসৃষ্টির পথে এগিয়ে গেছেন।  

স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে শিল্পচর্চায় মগ্ন হলেন তিনি। কিন্তু এর প্রস্তুতি মনে হয় আরও অনেক আগে থেকে তাঁর মনের মধ্যে চলছিল। এর প্রমাণ মেলে যখন তিনি ছোটবেলায় আকাশে মেঘের মধ্যে নানা আকার খুঁজে বেড়ানোর কথা বলেন। ‘শরতের আকাশে যখন মেঘ ভাসত আমাকে তখন কেউ খুঁজেও পেত না। মেঘ কখনও রাজপুত্র হয়, কখনও হয় রাজকন্যা, কখনও চাঁদের মা বুড়ি সাজে। এটা একটা অদ্ভুত মোহ ছিল। ’ কল্পনার এই খেলাই তাঁকে কখন শিল্পী করে তুলেছে তা তিনি নিজেই বোঝেননি।  

এর মধ্যে ১৯৭২ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন। স্বামী আহসানুল্লাহ আহমেদ সরকারি চাকুরে। স্বামীর চাকরির সুবাদে ফেরদৌসী দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেলেন। জঙ্গল, সমুদ্র ও পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য দেখে তাঁর কল্পনা যেন আরও ডালপালা মেললো। ফলে তাঁর শিল্পসৃষ্টির গতিও আরও বেড়ে গেলো।  

ফেরদৌসী তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি ভাস্কর্য তৈরি করেন ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে। যারা ‘ভাস্কর্য’ শব্দটির অর্থ জানো না তাদের জন্য ছোট্ট করে এর অর্থটা বলে দেই। ভাস্কর্য হচ্ছে পাথর, মাটি, কাগজের মণ্ড ইত্যাদি বিভিন্ন কিছু ব্যবহার করে তৈরি শিল্প উপকরণ। ভাস্কর্য অনেক কিছুরই হতে পারে- মানুষ, জীবজন্তু, প্রাকৃতিক বা অন্য ধরনের দৃশ্য। ভাস্কর্য তৈরি করে মানুষ নিজের সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করে, অন্য মানুষকে আনন্দ দেয় এবং জীবন সম্পর্কে ভাবতে শেখায়।

প্রিয়ভাষিণী মূলত ফেলে দেওয়া, পরিত্যক্ত জিনিস থেকে ভাস্কর্য তৈরি করেন। হয়ত বাগানে একটা ছোট ডাল পড়ে আছে, যার সেই কল্পনা নেই তার কাছে সেটা একটা খসে পড়া বা ভাঙা ডাল মাত্র। কিন্তু কল্পনাপ্রবণ শিল্পীর চোখে সেটা হয়ে উঠতে পারে একটা শুয়ে থাকা কুকুর কিংবা ছুটন্ত হরিণ। এই যে আশপাশ থেকে তুচ্ছ জিনিস সংগ্রহ করে তাকে একটা আকার দেওয়া, এই শিল্পের একটু খুব সুন্দর নাম আছে কিন্তু। এর নাম কুটুম-কাটাম। নামটি দিয়েছিলেন বিখ্যাত শিল্পগুরু আচার্য অবণীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ নিয়ে তাঁর অত্যন্ত সুন্দর কিছু কথাও আছে যা অন্য কোনো সময় তোমাদের শোনাব।  

প্রিয়ভাষিণীর প্রথম ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয় যশোরে। তিনি যে খেলার ছলে অপূর্ব সব ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিলেন তা প্রথম কার চোখে পড়ে জানো? তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্পীদের একজন। তিনি এসএম সুলতান। প্রিয়ভাষিণীর শিল্পগুরু তিনি। তাঁর কাছে শিল্প সম্পর্কে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছেন প্রিয়ভাষিণী। এসএম সুলতানের উৎসাহে ১৯৯১ সালে যশোরের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান চারুপীঠ তাঁর প্রথম প্রদর্শনীটি আয়োজন করে। সেখানে তাঁর কাজ দেখে সবাই মুগ্ধ হলেন। ঢাকায় প্রথম প্রদর্শনীটি হলো ১৯৯৪ সালে। তারপর আরও বহুবার তাঁর কাজের প্রদর্শনী হয়েছে। অবিরত কাজ করে গেছেন তিনি।  

সাহস আর সংগ্রামের উজ্জ্বল উদাহরণ প্রিয়ভাষিণী
‘প্রকৃতি তার ফর্মে নানা ধরনের ভাঙচুর চলে। গাছের ডাল কখনও আনন্দের কথা বলে, কখনও যুদ্ধের কথা বলে। কখনও নির্যাতিতের কথা বলে, কখনও সমুদ্রের কথা বলে। নৌকার কথাও বলে কখনও। ঠিক যেটা ফর্মে আসবে আমি সেটাই বানাই,’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ফেরদৌসী। সব শিল্পীর মতো তাঁর কথাতেও ফর্মের বিষয়টি বারবার এসেছে। ফর্ম অর্থ কাঠামো বা আকার। তিনি গাছের ডাল কিংবা অন্য বস্তুর মধ্যে আকার আবিষ্কার করতেন আর সেটাকে আরও স্পষ্ট রূপ দিতেন। আর তার মধ্যে দিয়েই একেকটি শিল্পবস্তু গড়ে উঠতো।  

চাকরি আর শিল্পচর্চার মধ্যে সংসারের হাজার কাজ সামলাতে হয়েছে তাঁকে। মানুষ করেছেন ছয়টি ছেলেমেয়েকে। তাদের নাম কারু তিতাস, কাজী মোহাম্মদ নাসের, কাজী মোহাম্মদ শাকের (তূর্য), রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনী, রত্নেশ্বরী প্রিয়দর্শিনী ও ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী। তাঁদের মধ্যে কারু তিতাস মায়ের মতোই শিল্পী হয়েছেন। মায়ের সম্পর্কে বড় মেয়ে রাজেশ্বরী একবার বলেছিলেন, মা তাঁদের স্বাধীনতায় কখনও বাধা দেননি, কিন্তু নিয়মের মধ্যে মানুষ করেছেন। তাঁরা যাতে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে না যান সেদিকে তাঁদের মায়ের ছিল কড়া নজর। রাজেশ্বরী মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

সন্তান হারানোর গভীর শোক আর নিজের অসুস্থতার মধ্যেও কাজ করে গেছেন এই শিল্পী। অবশেষে অসুখের কাছে হার তাঁকে মানতেই হলো। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৬ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।

অপূর্ব ভাস্কর্যের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০১০ সালে সরকার তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বাধীনতা পদক প্রদান করে।  

স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য চরম আত্মত্যাগ, কঠোর সংগ্রাম আর শিল্পসাধনায় কেটে গেছে এই প্রখ্যাত ভাস্করের জীবন। কঠিন জীবনের প্রতিটি দিন এক সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। তাঁর ভাষায় সেই দেশ হবে, ‘একটা সুন্দর বাংলাদেশ, একটা সভ্য বাংলাদেশ, মানবসম্পন্ন, সমাজসম্পন্ন, সংস্কৃতিসম্পন্ন, নির্ভীক বাংলাদেশ, রাজাকারবিহীন বাংলাদেশ। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।