ঢাকা, শুক্রবার, ১ কার্তিক ১৪৩২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

ফিলিস্তিনের এক সময়কার বন্ধু ভারত যেভাবে ইসরায়েলের মিত্র হলো

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৩৮, অক্টোবর ১৬, ২০২৫
ফিলিস্তিনের এক সময়কার বন্ধু ভারত যেভাবে ইসরায়েলের মিত্র হলো

প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অথরিটির (পিএলও) প্রবাদপ্রতিম নেতা ইয়াসির আরাফাত ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সবসময় ‘আমার বড় বোন’ বলে সম্বোধন করতেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নন-অ্যালাইনমেন্ট মুভমেন্টের (ন্যাম) শীর্ষ সম্মেলনে তিনি ‘রাষ্ট্রনেতা’ হিসেবে উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছিলেন।

সমকালীন পর্যবেক্ষকরা সবাই একমত, ইন্দিরা গান্ধী ও আরাফাতের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভরসার সম্পর্ক ছিল। সেই আস্থা কেবল ব্যক্তিগত নয়, ভারতীয় ও ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সেই সম্পর্ক ফিকে হয়ে যায়। এখন ভারতের পরম মিত্র ইসরায়েল।  

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, প্রত্যেকে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকারকে সমর্থন করেছেন। ভারতের জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃত মোহনদাস গান্ধীও ফিলিস্তিনের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্রতি বছর শত শত ফিলিস্তিনি ছাত্র দেশটির মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশোনা করতে আসত। ভারতের আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনে ত্রাণ, রসদ ও সাহায্য পাঠানো হতো নিয়মিত। এই সমর্থনের ধারাই পুরো আশির দশক পর্যন্ত বজায় ছিল।

ভারত সর্বদা উপনিবেশবাদবিরোধী নীতি নিয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রতি ভারতের সহমর্মিতা ছিল তার নীতিগত অবস্থানের বড় দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতা পাওয়া মাত্রই ভারত জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে ‘পার্টিশন প্ল্যানে’ বিভক্ত করার প্রস্তাবে বিরোধ জানিয়েছিল এবং ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্তিরও প্রতিবাদ করেছিল।

১৯৭৪ সালে ভারত বিশ্বের প্রথম নন-আরব দেশ হিসেবে পিএলওকে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরের বছর দিল্লিতে পিএলওর কার্যালয় চালু হয়। ১৯৮৮ সালের ১৮ নভেম্বর ভারত ফিলিস্তিনকে ‘রাষ্ট্র’ হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়, এবং পশ্চিম তীরের রামাল্লায় পরবর্তী সময়ে ভারতীয় ‘প্রতিনিধি কার্যালয়’ চালু হয়।

নব্বই দশকের শুরুতে ভারতের ফিলিস্তিন নীতিতে পরিবর্তনের সূচনা হয়। ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই উদ্যোগের পেছনে ছিলেন সাবেক শীর্ষ কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রদূত রণেন সেন, যিনি তখন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন।

বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারে রণেন সেন জানান, ১৯৮৫ সালে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজের সাক্ষাৎকালে ইসরায়েলের প্রতি ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ শুরু হয়। পেরেজের গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি রাজীব গান্ধীকে মুগ্ধ করেছিল।

তিনি বলেন, রাজীব গান্ধীকে শিমন পেরেজ এটাও বোঝাতে পেরেছিলেন পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত যেমন ‘গণতন্ত্রের একমাত্র দ্বীপ’, পশ্চিম এশিয়ায় ইসরায়েলও ঠিক তেমনটাই। পরবর্তীতে ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে উভয় দেশই যে উপকৃত হবে, এ তত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন দুই নেতাই।   

এরপরই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ মেনে রণেন সেন পরবর্তী চার বছরে ভারত বিভিন্ন রোডম্যাপ অনুসরণ করে ডেভিস কাপ টেনিসে ইসরায়েলের পতাকা প্রদর্শন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় তাদের প্যাভিলিয়ন তৈরি, বোম্বেতে ইসরায়েলি কনস্যুলেটের কার্যক্রম সম্প্রসারণ ইত্যাদি কার্যক্রম শুরু করেন। তবে রাজীব গান্ধীর পরবর্তী স্বল্পমেয়াদি সরকারগুলো এই উদ্যোগকে এগোতে না দিয়ে স্থগিত রাখে।

ইসরায়েল অবশেষে ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতি পায় কংগ্রেস নেতা পিভি নরসিমহা রাওয়ের আমলে। সেই সময় পিএলওর নেতা ইয়াসের আরাফাতকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, তার সঙ্গে আরাফাতের দেখা হয়েছিল। তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘একমাত্র আপনি ভারতের এই বিপর্যয়ের পথে যাওয়া থামাতে পারেন। ’ পরের দিন নরসিমহা রাও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আপগ্রেডের ঘোষণা দেন, আর আরাফাত তা স্বাগত জানান।

কিন্তু তখনও এটি আলোচনায় ছিল না যে, নরওয়ের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি নেতৃত্বর মধ্যে গোপন আলোচনা চলছে এবং বিখ্যাত অসলো চুক্তিও ততদিনে চূড়ান্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এতে ভারতের ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ফিলিস্তিনের সুবিধা আনার বদলে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি করেছিল।

মণিশঙ্কর আইয়ার মনে করেন, ইয়াসির আরাফাত হয়তো তখন ভেবেছিলেন ভারত যদি ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে সম্ভবত ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের প্রতিশ্রুত ‘দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান’ অর্জনে ফিলিস্তিনের সুবিধা হবে। কিন্তু সেটা কোনোদিনও হয়নি।  

দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের অধ্যাপক জোয়া হাসান বলেছেন, ১৯৯২ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনের প্রতি ভারতের সমর্থন কমতে থাকে। মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এই পরিবর্তন আরও গভীর হয়। ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একসঙ্গে ইসরায়েলের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করে।

কার্গিল যুদ্ধের পর ভারতের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য ইসরায়েল থেকে অস্ত্র আমদানি শুরু হওয়ায় সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। মোদীর সরকার আসার পর ভারত-ইসরায়েল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ একটি নতুন মাত্রা নেয়।

ফলে, দীর্ঘদিন ধরে নৈতিকতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করা ভারত এখন সেই নীতির বাইরে চলে আসে। জোয়া হাসান উল্লেখ করেন, গাজায় ৫৫ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হওয়ার পরও ভারত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নিজেদের গ্লোবাল সাউথের নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় দেখতে চাইলেও এই প্রশ্নে ভারতের কোনো অবস্থান ছিল না। এটি ভারতের রাষ্ট্রীয় লিগ্যাসির সঙ্গে এক ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতার সামিল!

তিনি মনে করেন, যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন এক সময় ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম মূল স্তম্ভ ছিল, ইসরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে সেই স্তম্ভকেই মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে।  

জোয়া আরও বলেন, নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকারের সময় থেকে ভারত-ইসরায়েলের এই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ একটা ভিন্ন মাত্রা নিতে থাকে। ইসরায়েলি ব্র্যান্ডের ‘হার্ডলাইন জাতীয়তাবাদ’ ও ‘সিকিওরিটি-ফার্স্ট ডকট্রিনকে’ তার দেশ ধারণ করতে শুরু করে।

ভারতের বুকার বিজয়ী লেখক অরুন্ধতী রায় জানিয়েছেন, সাধারণ মানুষের ফিলিস্তিন সমর্থন আজ হারিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা ভাবছেন, ভারত আগের মতো তাদের বন্ধু নয়। বিশেষত হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ও ইসরায়েলের জাওনিজমের আদর্শগত মিল ভারতকে ফিলিস্তিনের কাছ থেকে আরও দূরে নিয়ে গেছে।

প্রায় আশি শতাংশ হিন্দু দেশ ভারত স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চাশ বছরে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করলেও, আজ ধর্মনিরপেক্ষতা, নৈতিকতা বা মানবিকতার প্রভাব কমে গেছে। সাম্প্রতিক এক পিউ রিসার্চ জরিপে দেখা গেছে, অন্তত ৩৪ শতাংশ ভারতীয় গাজায় ইসরায়েলের হামলাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাচ্ছেন। ইসরায়েলের ভূমিকায় আপত্তি জানিয়েছেন ২৯ শতাংশ মানুষ। ভারতে ইসরায়েলের সমর্থকের সংখ্যা আসলে বহু পশ্চিমা দেশের চেয়েও অনেক অনেক বেশি বলেও জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।  

ফলে, ফিলিস্তিনি ও ভারতীয়দের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব শুধু রাষ্ট্রীয় নীতি নয়, সামাজিক মানসিকতাও প্রভাবিত করছে।

অরুন্ধতী রায় জানান, তিনি বিশ্বাস করেন ভারত এখন আর ফিলিস্তিনের বন্ধু নয়। নিপীড়িত মানুষের সঙ্গী হিসেবে ভারতের যে মর্যাদার জায়গাটা ছিল, সেটা তারা খুইয়েছে।  

এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।