ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৫ আশ্বিন ১৪৩২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

দিমা ফাইয়াদের গল্প: ক্ষুধা নিবারণে খাবার ‘নকল’ করে খায় ফিলিস্তিনিরা

অনুবাদ: মো. জুবাইর, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৫৬, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
দিমা ফাইয়াদের গল্প: ক্ষুধা নিবারণে খাবার ‘নকল’ করে খায় ফিলিস্তিনিরা

ইসরায়েলের অবরোধ আর দুর্ভিক্ষের চাপে পুরো গাজা যখন খাদ্যশূন্য, তখন বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন নতুন উপায়ে খাবার তৈরি করে খেতে শিখেছে মানুষ। সোজা কথায় ‘নকল’ খাবার  তৈরি করে খাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা।

আমার পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়। অল্প সরবরাহের খাবারকে কীভাবে বেশি সময় পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা যায়, নেই এমন উপাদানকে কীভাবে অন্যকিছুর মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া যায়, নুসেইরাতে এমন লড়াই করছি আমরা। এই লড়াই আমাদের রান্নাঘরকে কার্যত একটি পরীক্ষাগার হিসেবে গড়ে তুলছে।

গমের আটা ফুরিয়ে গেলে গাজার মতো আমরাও পাস্তা দিয়ে রুটি বানাতে শুরু করি। গাজায় রুটি ছাড়া খাবার কল্পনা করা যায় না। চলমান দুর্ভিক্ষে বাজারে নেই কোনো ফল, সবজি, ডিম, পনির, মুরগি বা মাংস। তাই মানুষ পাস্তা সেদ্ধ করে সেটিকে আটার মতো চটকে রুটি বানিয়ে খাচ্ছে। পাস্তার রুটির স্বাদ বা গুণ যতটা খারাপ হওয়ার কথা ভেবেছিলাম, বাস্তবে ততটা খারাপ লাগেনি। তবে তৈরি করা অনেক কঠিন। এটিকে স্বেদ্ধ আটার মতো চটকে খামির বানাতে হয়। তারপর রুটির আকার দিয়ে কমিউনিটি ওভেনে গিয়ে ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। প্রথমবার যখন আমাদের রুটি তৈরি হলো, দেখতে ছিল ঠিক সাধারণ রুটির মতোই, স্বাদও মন্দ লাগেনি।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাস্তার দামও আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। তখন বিকল্প খুঁজতে গিয়ে আমরা ডালের দিকে ঝুঁকলাম। ডাল গুঁড়া করে সামান্য আটা মিশিয়ে বানানো রুটি ছিল এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। স্বাদে একেবারে ডালের মতো, গলা দিয়ে নামে না। ঝোল জাতীয় কোনো খাবারে পদ তৈরি আমাদের জন্য মরুভূমিতে সুঁই খোজার মতো। একদিন রেখে দিলে পরদিন সেটি পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। তারপরও আমরা আগামীর কথা চিন্তা করে রুটিগুলো রেখে দিই। আগুনে গরম করে নরম করার চেষ্টা করি। নরমে হলে দ্রুত খেতে হয়। গিলে খাওয়ার সময় গলা ধরে আসে। মনে হয় যেন গলায় ধুলা আটকে যাচ্ছে।

ডালের তৈরি শুকনো মসলা ‘দুক্কা’ দিয়েই চলছিল সকালের নাশতা ও রাতের খাবার। আমার ভাই ফাদি ঠাট্টা করে বলত, ‘ডাল দিয়ে বানানো রুটির ভেতর আবার ডাল!’

গত মে মাসের এক দিনে স্বেচ্ছাসেবার কাজ শেষে আমি গেলাম আমার বড় বোন ফিদার শেল্টারে। দেইর এল-বালাহের শেল্টারে তিনি তার চার সন্তানকে নিয়ে সেখানে থাকেন। সেদিনের বিশেষ আয়োজন ছিল ‘নকল বার্গার’। ফেসবুকের এক রেসিপি দেখে ফিদা ক্যানের মাংস আর ডাল দিয়ে প্যাটিস বানাচ্ছিলেন। তাতে মশলা মিশিয়ে কিছুটা স্বাদ আনার চেষ্টা হয়েছিল। রান্নার পর বার্গারের গন্ধ খারাপ লাগেনি, কিন্তু টেক্সচার ছিল ভীষণ ভঙ্গুর। বান ছিল না, তাই সাধারণ রুটি দিয়েই তৈরি হলো বার্গার, আদতে স্যান্ডউইচ। প্রথম কামড় মোটামুটি লাগলেও পরে আর গিলতে মন চায়নি। কিন্তু আমরা একটিও অবশিষ্ট রাখিনি।

শিশুদের মুখে সামান্য হাসি ফোটাতে জুন মাসে আমার ভাইয়ের স্ত্রী দোহা বানালেন নকল চকোলেট স্প্রেড। সাহায্যের প্যাকেটে পাওয়া হালভা, পানি ও কোকো মিশিয়ে তৈরি সেই স্প্রেডে হালভার স্বাদ থাকলেও কোকো মিশিয়ে খেতে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু কোকো ফুরিয়ে যাওয়ায় তা দুয়েকবারের বেশি বানানো যায়নি।

লবণাক্ত স্ন্যাকসের জন্য আমরা পাস্তা ভেজে ‘ফেক চিপস’ বানালাম; এটি দুর্ভিক্ষের সময় গাজার বিখ্যাত খাবার। এক শুক্রবারে প্রতিবেশী আফনান ভাজলেন ছোলা, মশলা মিশিয়ে বানালেন ‘নকল বাদাম’। খেতে দারুণ লাগলেও কাঠ জ্বালিয়ে বারবার বানানো কষ্টসাধ্য।

আমরা রসিকতা করে বলি, নানান রকম খাবার খাচ্ছি, কিন্তু উপাদান সব সময় একই, ছোলা, পাস্তা আর সবচেয়ে বেশি ডাল। একসময় ত্রাণের পণ্য হিসেবে আসত, এখন সেগুলোও দুর্লভ। আমার বোন মারিয়াম তিক্ত হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘পাস্তা আর ডালকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। এরা না থাকলে এতদিন টিকে থাকতে পারতাম না।

কিন্তু আমার মনে হয়, এই অবরোধের অবসান হলে আমি সবকিছু খেতে চাই; শুধু এই কয়েক মাসের খাবার বাদে। আমি ক্ষতিপূরণ চাই। প্রতিটি ক্ষুধার্ত মুহূর্তের, প্রতিটি ফল, সবজি, ডিম, মুরগির তীব্র আকাঙ্ক্ষার জন্য ক্ষতিপূরণ চাই। প্রতিটি মাথা ঘোরানো ক্ষুধার জন্য ক্ষতিপূরণ চাই।

গাজার এই দুর্ভিক্ষ কেবল খাদ্য নয়, মানুষের স্বপ্নকেও ‘নকল’ করে ফেলেছে। এখন শুধু অপেক্ষা, কবে এই অবরোধ ভাঙবে, কবে সত্যিকারের খাবারের স্বাদে আবার ফিরতে পারব আমরা।

কাতারের সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় গল্পটি লিখেছেন দিমা ফাইয়াদ। যিনি বসবাস করেন নুসেইরাতে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে।  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।