মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ইরান সংঘাত যখন আরও গভীরতর হচ্ছে, তখন এর বিস্তৃতি নতুন এক মাত্রায় পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্র—বিশেষত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প—এই সংঘাতে সরাসরি হস্তক্ষেপের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
সামরিক প্রস্তুতি, কূটনৈতিক ইঙ্গিত, এবং রাজনৈতিক ভাষ্য—সবকিছু মিলে এক ভয়াবহ বাস্তবতার দিকে নির্দেশ করছে— আর তা হল যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সরাসরি আঘাত হানার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
জি-৭ সম্মেলনের মঞ্চ থেকে আগেভাগেই কানাডা ত্যাগ করা ট্রাম্পের আচরণ ছিল অস্বাভাবিক রকম দ্রুতগামী।
‘তেহরান থেকে সবাই যেন তৎক্ষণাৎ সরে যায়’— এই একবাক্যের হুঁশিয়ারি শুধু উসকানিমূলক নয়, যুদ্ধের পূর্বাভাস। এক কোটি মানুষের রাজধানীকে লক্ষ্য করে এমন ঘোষণা কোনো প্রতীকী বার্তা নয়— এটি এক বাস্তব হুমকি।
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার নতুন এই ঢেউয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা ফের সামনে চলে এসেছে, যার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ভারত মহাসাগরের ডিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে ছয়টি বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান মোতায়েন।
এটি কেবল একটি কৌশলগত প্রস্তুতি নয়— বরং ইরানকে দেওয়া একটি অঘোষিত আল্টিমেটাম। যুক্তরাষ্ট্র এখন কেবল বাকযুদ্ধে নয়, সরাসরি সামরিক সংঘাতের জন্য বাস্তব প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।
ডিয়েগো গার্সিয়ার ঘাঁটি থেকে প্রায় ৩,৯০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ইরান। এই দূরত্ব আধুনিক স্টেলথ প্রযুক্তির বি-২ বোমারু বিমানের জন্য তেমন কিছু নয়। এই বিমানগুলো ‘ম্যাসিভ অর্ডিনেন্স পেনেট্রেটর’ বা এমওপি নামক ৩০,০০০ পাউন্ডের বাঙ্কার-ধ্বংসকারী বোমা বহনে সক্ষম—যার মূল লক্ষ্য হতে পারে নাতানজ, ফোর্দো, আরাকসহ ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনা। এই বোমা শুধু একটি অবকাঠামো ধ্বংসের অস্ত্র নয়, বরং একটি বার্তা—‘নিরাপদ বলে কিছু নেই। ’
বি-২ মোতায়েনের প্রকৃত অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রি এম্পটিক স্ট্রাইক’ বা পূর্বপ্রতিরোধমূলক হামলার প্রস্তুতি। বিশ্বরাজনীতিতে যেটি প্রায়ই যুদ্ধ শুরুর একধাপ আগের পর্ব হিসেবেই ধরা হয়।
এ কৌশল শুধু আকাশেই সীমাবদ্ধ নয়। মার্কিন রণতরী ইউএসএস নিমিৎস এবং তার স্ট্রাইক গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রা, কেসি ১৩৫আর ও কেসি-৪৬এ ট্যাংকার বিমানের বিশাল বহরের গমন এবং ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ— সব মিলিয়ে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ প্রস্তুতির কাঠামো।
এই প্রস্তুতি বোঝায়, যুক্তরাষ্ট্র একাধিক দিক থেকে ইরানকে চেপে ধরছে— বিমান হামলার হুমকি, নৌ অবরোধের সম্ভাবনা, এবং সাইবার বা ইলেকট্রনিক যুদ্ধের ব্যবস্থাও আলোচনার বাইরে নয়।
ভারত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত ডিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ এক অর্থে ‘ভাসমান ঘাঁটি’। এটি যে শুধু বোমারু বিমান পাঠানোর এক পয়েন্ট তাই নয়, বরং পুরো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানের অন্যতম স্তম্ভ। ইরান কিংবা ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে আঘাত হানা হোক, কিংবা পারস্য উপসাগরে তেলের রুট নিরাপদ রাখা— সবই এ ঘাঁটির আওতায়।
যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানে হামলা শুরু করে, যুদ্ধের রূপ হবে অল্প সময়ে নির্ভুল ও অতি ধ্বংসাত্মক হামলা। প্রথম ধাক্কায় ধ্বংস হতে পারে ইরানের বিমান ঘাঁটি, রাডার স্থাপনা, পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র, এবং বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর রণক্ষমতা।
তবে ইরানও নিশ্চুপ থাকবে না। হরমুজ প্রণালীতে তেল চলাচল বন্ধ করে বিশ্ববাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি, ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, কিংবা হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে পশ্চিমা স্বার্থে হামলা চালানো— সবই সম্ভাব্য পাল্টা পদক্ষেপ।
এই সমগ্র প্রস্তুতির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো— এটি কি কেবল চাপ সৃষ্টির কৌশল, নাকি একটি আসন্ন যুদ্ধের প্রাক-মুহূর্ত?
যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযান শুরু করে, তবে তা মধ্যপ্রাচ্যকেই নয়—পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যকে আমূল নাড়িয়ে দিতে পারে।
ডিয়েগো গার্সিয়াতে বি-২ বোমারু বিমানের ছায়া যেন শুধু দ্বীপের বালুমাটিতে নয়, বরং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির আকাশে যুদ্ধের সম্ভাবনার এক গভীর ছায়া ফেলে রেখেছে।
এমএম