যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে জড়াবে কি না, তা নিয়ে এখন বিশ্বজুড়ে জোর আলোচনা চলছে। ইসরায়েলের সাবেক কূটনীতিক আলোন পিঙ্কাস মনে করেন, ওমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় পরমাণু আলোচনা বানচাল করাই ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য ছিল না।
তিনি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, এই আলোচনা ভেস্তে যাওয়া ইসরায়েলের জন্য বাড়তি লাভ হলেও হামলার সময় বেছে নেওয়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তার মতে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কখনোই বলেননি এই হামলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী। ধারণা করা হচ্ছে, তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ইরানের সামরিক সক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া।
পিঙ্কাস মনে করেন, নেতানিয়াহু চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রকে এই সংঘাতে টেনে আনতে। তবে একবার যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়লে পুরো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে ওয়াশিংটনের হাতে, তখন নেতানিয়াহু আর কার্যকর কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারবেন না। তিনি বলেন, “আমি মনে করি না যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে সরাসরি জড়াবে। তবে আবার, বিষয়টা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর নির্ভর করছে—তিনি সকালে এক কথা বলেন, বিকেলে আরেক কথা।
এদিকে, তেহরানে এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, ইরান চায় না এই সংঘাত প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ুক— যদি না তারা বাধ্য হয়। তিনি ইরানের সামরিক প্রতিক্রিয়াকে আত্মরক্ষামূলক বলে উল্লেখ করেন।
ইসরায়েলের বিমান হামলা চলতে থাকলেও আরাগচি আবারও বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের বিপক্ষে, তবে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকার তাদের রয়েছে। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ষষ্ঠ দফা আলোচনায় ইরান কিছু আশ্বাস দিতে প্রস্তুত ছিল, যা থেকে একটি চুক্তিও হতে পারত। তবে সেই আলোচনা এখন বাতিল হয়ে গেছে। তার অভিযোগ, ওয়াশিংটনের সঙ্গে কূটনৈতিক অগ্রগতি নষ্ট করতেই ইসরায়েল এই হামলার পথ বেছে নিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ইরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করা হয়, তাহলে আমেরিকার সামরিক শক্তি এমনভাবে নেমে আসবে যা আগে কেউ দেখেনি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসরায়েলের হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
ট্রাম্প আরও লেখেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে খুব সহজেই একটি চুক্তি সম্ভব, এবং এই রক্তাক্ত সংঘাত থামানো যেতে পারে! তিনি ইসরায়েলের হামলাকে ‘দারুণ’ বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, ওয়াশিংটন আগেই জানত ইসরায়েল আক্রমণ চালাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানে হামলায় অংশ নেয়নি, বরং ইসরায়েলকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সহযোগিতা করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের কিছু পরমাণু স্থাপনা এতটাই গভীরে নির্মিত যে তা ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমা প্রয়োজন—যা ইসরায়েলের নেই। হামলার আগেই ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি চান না ইসরায়েল ইরানে হামলা করুক, তবে সেটা আলোচনার টেবিলে ছিল। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাম্পের এমন মন্তব্য কৌশল হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।
রোববার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি আরও দাবি করেন, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ও ঘাঁটিগুলোর সরাসরি সহযোগিতার প্রমাণ তেহরানের কাছে রয়েছে। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, আমাদের কাছে জোরালো প্রমাণ রয়েছে যে, এই অঞ্চলে থাকা মার্কিন বাহিনী ও ঘাঁটিগুলো ইসরায়েলের হামলায় সহায়তা করেছে।
এর মধ্যেই ট্রাম্প জানিয়েছেন, শনিবার সকালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি ইরান পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ট্রাম্প বলেন, আমরা অনেকক্ষণ কথা বলেছি। পুতিন মনে করেন, এই ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ হওয়া উচিত। আমিও তার সঙ্গে একমত। আমি তাকে বলেছি, তার যুদ্ধ— অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ— সেটাও বন্ধ হওয়া দরকার।
রুশ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ জানিয়েছেন, পুতিন ইরানে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং এ ধরনের হামলা পুরো অঞ্চলে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করছে বলে মত দিয়েছেন।
ইসরায়েল শুক্রবার ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। হামলায় ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হন। এরপরই পাল্টা হামলায় নামে ইরান। শনিবার রাতভর দফায় দফায় হামলা চলে দুই দেশের মধ্যে। আজ রোববারও পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে হামলা হয়েছে। ইসরায়েল আবার দাবি করেছে, তারা গত এক ঘণ্টায় ২০টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
ইসরায়েল-ইরান পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে নতুন করে সামনে এসেছে এক অশনি সঙ্কেত। আর তা হলো— হরমুজ প্রণালী বন্ধের ইঙ্গিত। যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতির অধ্যাপক অ্যাড হার্স মনে করেন, যদি ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে, তবে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অর্থনৈতিক আগ্রাসনের মতো হয়ে উঠবে। তার মতে, এমন একটি পদক্ষেপ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযানের সংবেদনশীল অজুহাত হিসেবে কাজে লাগাতে পারে।
আরএইচ