যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয় যেসব অত্যাধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—সেগুলোর জন্য দরকার বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। কিন্তু দেশটির জন্য আশঙ্কার বিষয় হলো, এসব খনিজের বেশিরভাগই আসে চীন থেকে।
বিশ্বের প্রক্রিয়াজাত ও পরিশোধিত বিরল খনিজের ৯০ শতাংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে বেইজিং। গ্যালিয়ামের মতো কিছু খনিজের ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ ৯৮ শতাংশের কাছাকাছি। শুধু সরবরাহ নয়, চীন একাধিক ধাপে প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাতেও সবার থেকে এগিয়ে।
২০২৩ থেকে ২০২৫—এই সময়ের মধ্যে চীন একের পর এক রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম, অ্যান্টিমনি—এইসব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রপ্তানির জন্য এখন অনুমতি নিতে হয়। ২০২৫ সালের এপ্রিলে তো আরও এক ধাপ এগিয়ে, স্যামারিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, টার্বিয়াম, ডাইস্প্রোসিয়াম, লুটেশিয়াম, স্ক্যান্ডিয়াম এবং ইট্রিয়ামের মতো মধ্য ও ভারী বিরল খনিজ এবং এসব দিয়ে তৈরি চুম্বক ও পণ্যের জন্য বিশেষ রপ্তানি লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়।
এইসব খনিজ শুধুই নাম নয়—এসব হলো যুক্তরাষ্ট্রের ফাইটার জেট, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, ক্ষেপণাস্ত্র ও রাডার সিস্টেমের প্রাণ। একটি ভার্জিনিয়া-শ্রেণির সাবমেরিনে প্রায় ৯,২০০ পাউন্ড বিরল খনিজ লাগে। একটি আর্লেই বার্ক শ্রেণির যুদ্ধজাহাজে লাগে ৫,২০০ পাউন্ড। এফ-৩৫ ফাইটার জেটে প্রায় ৪০০ কেজি বিরল খনিজ লাগে, যার মধ্যে রয়েছে জেট ইঞ্জিন, রাডার, অস্ত্র ব্যবস্থা ও অ্যাভিওনিক্স। প্রিডেটর ড্রোন, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র, জেডিএএম (জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন) স্মার্ট বোমা এবং উন্নত রাডার সিস্টেম—এই সব আধুনিক যুদ্ধসরঞ্জাম নির্ভর করে বিরল খনিজের ওপর, যা এগুলোর প্রপালশন, লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ ও দিকনির্দেশনা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নতুন প্রজন্মের এফ-৪৭ (এনজিএডি) যুদ্ধবিমান যেটিতে ড্রোন ও এআই ব্যবহার হবে, তাতে এসব খনিজের ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের তথ্য বলছে, তাদের অস্ত্র সরবরাহ চেইনের ৮০ শতাংশের বেশি কোনো না কোনোভাবে গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম বা অ্যান্টিমনির ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু এসব উপাদানের কার্যকর বিকল্প নেই, তাই সরবরাহ বিঘ্নিত হলে পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা থেমে যাবে। যার কারণে এইসব খনিজে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা মার্কিন প্রযুক্তি-স্বাধীনতা অর্জনের পথেও বড় বাধা। কারণ, খনিজ প্রক্রিয়াকরণ ও পরিশোধনের জ্ঞান ও যন্ত্রপাতির অনেক কিছুই এখন চীনের নিয়ন্ত্রণে।
গত পাঁচ বছরে অভ্যন্তরীণ খনিজ প্রক্রিয়াকরণে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৪৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এমপি ম্যাটেরিয়ালস নামে একটি কোম্পানিকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার অনুদানও দেওয়া হয়েছে ভারী বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য। তবে চীনের বর্তমান দাপট ঠেকাতে এই উদ্যোগগুলো এখনো অনেকটাই অপর্যাপ্ত।
২০২৪ সালের তথ্য বলছে, বিশ্বের বিরল খনিজের ৬৯ শতাংশই উৎপাদন করে চীন। যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদন করে মাত্র ১১.৫ শতাংশ। বাকি উৎপাদন মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও কিছু আফ্রিকান দেশের হাতে। ভারতে উৎপাদন মাত্র ০.৭ শতাংশ, রাশিয়ায় তার চেয়েও কম। এর অর্থ চীনের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ফলে কাঁচামাল সরবরাহ কমে গেলে, আমেরিকার প্রতিরক্ষা শিল্পের সরবরাহ চেইন আরও অসহায় হয়ে পড়ছে, যা দেশটির সামরিক প্রস্তুতিতে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট
এমএম