ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২, ০৮ জুলাই ২০২৫, ১২ মহররম ১৪৪৭

ভারত

ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি কি বদলে যাবে?

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৪৫, জুলাই ৮, ২০২৫
ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি কি বদলে যাবে?

কলকাতা: কাশ্মীরে পহেলগাঁও হামলার পরে বাতিল হয়েছিল সিন্ধু পানিচুক্তি। এবার গঙ্গার পানিবন্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশে মধ্যে, চুক্তি নবায়নের বিষয়ে জল্পনা বাড়ছে।

 

অনেকে মনে করছে বাংলাদেশেকে কৌশলে চাপে রাখতে বদল হতে পারে চুক্তির নিয়ম। আবার অনেকেই মনে করছেন, স্থায়ী নির্বাচিত সরকার না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকতে পারে গঙ্গাচুক্তির নবায়নে। আবার অনেকেই মনে করছেন, গঙ্গাচুক্তি নবায়নে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়া হতে পারে। আর তাই যদি হয়, তাহলে তিস্তা চুক্তির মত ঝুলে যেতে পারে গঙ্গা চুক্তির নবায়ন।

অপরদিকে, বিভিন্ন মাধ্যম মনে করছে, সিন্ধু চুক্তির মত বাতিল হবে না গঙ্গা। তবে তিরিশ বছর পরে আগামী ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে যে চুক্তি হবে তাতে বদল আনা হতে পারে।

এ বিষয় কলকাতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়  আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কিত, অধ্যাপক ড: কনক সরকার বলেছেন, ১৯৯৬ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে দশ দিনের জন্য বাংলাদেশকে ন্যূনতম ৩৫ হাজার কিউসেক পানি সরবরাহ করতে বাধ্য ছিল ভারত। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে এই পানি দেওয়ার জন্য, ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের কিছুক্ষেত্রে পানির সমস্যা হলেও বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক রাখার জন্য ওই পরিমাণ পানি সরবরাহে রাজি ছিল ভারত। এমনকী, তাতে সম্মতি ছিল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের  মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুরও।

কিন্তু বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে পরিস্থিতি ভিন্ন। ফলে নতুন চুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের আভ্যন্তরীণ উন্নয়নমূলক বিষয়গুলি বেশি গুরুত্ব পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এই এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতামতকে মান্যতা দিতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্পষ্ট নির্দেশ, ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ বঞ্চিত করে চুক্তি করা ঠিক হবে না। এই মর্মে একাধিকবার মোদি সরকারকে চিঠিও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

মমতা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বাড়ছে। শিল্প স্থাপনার সম্ভাবনা দিনে দিনে উজ্জ্বল হচ্ছে রাজ্যে। শিল্পর ক্ষেত্রে পানির গুরুত্ব অনেকখানি। তার উপর আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে বঙ্গে গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, পানিবন্টন চুক্তিতে বদল আনতে হবে।

১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল ফরাক্কা বাঁধ থেকে বাংলাদেশের জন্য পর্যাপ্ত পানির বন্দোবস্ত করা। পরবর্তীতে ফরাক্কায় পানিবন্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দের অবসান ঘটে। ১৯৭৫ সালে ফরাক্কা বাঁধ সচল হয়। ভাগীরথী নদীর ওপর এই বাঁধ বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গা থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পানি একটি খাল বা ক্যানেলের মাধ্যমে হুগলিতে নিয়ে যাওয়া হয়। যাতে কলকাতা বন্দর নৌ-চলাচলের উপযোগী থাকে।

অন্যদিকে, প্রতিবছর পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত, বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার চুক্তি মেনে নেয় উভয় দেশ। এতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে খুলনা বিভাগের কৃষি, পানীয় জল এবং লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণের জন্য গঙ্গার পানি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশ চাইছে পানির যোগান অব্যাহত থাক। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের কৃষি, নৌ চলাচল যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য চিন্তিত ইউনূস সরকার।

অন্যদিকে, আগামী বছর চুক্তি নবায়নের আগে ভারত কয়েকটি বিষয়ের ওপরে জোর দিতে চাইছে। কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান ইউনূস সরকারের আমলে ভারত এখন 'সফট ডিপ্লোমেসি' থেকে সরে এসে জাতীয় স্বার্থই প্রথম নীতি হিসেবে জোর দিচ্ছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনকে মাথায় রেখেই এই চুক্তি নবায়ন করতে চাইছে ভারত সরকার।

কারণ, গত তিরিশ বছরে গঙ্গা সংলগ্ন এলাকায় জনসংখ্যা আগের তুলনায় অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতে পানির চাহিদা এবং যোগানের মধ্যে ফারাক বেড়েছে। যা তিরিশ বছর আগে পুরনো চুক্তিতে প্রতিফলিত হয়নি।

ভারত মনে করছে, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সরবরাহের বদলে বাস্তবসম্মত পানিবন্টন ব্যবস্থা চালু হোক। যা পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হবে। এবিষয়ে, রবীন্দ্রভারতীর ম্যাস কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান (এইচওডি) দেবোজ্যোতি চন্দ বলেছেন, এটা রাজনৈতিক বিষয় নয় এবং অবশ্যই দুই দেশের স্বার্থ দেখতে হবে। কারণ পানি কখনও বন্ধ রাখা যায় না। তবে মমতা বন্দ্যোপাধায় কোনো অনৈতিক দাবি করেননি। সেক্ষেত্রে ভারতে অঙ্গ রাজ্যর গুরুত্বটাও কেন্দ্র সরকারকে বুঝতে হবে এবং সেই কারণেই চুক্তির বদল হবে বলেই মনে করছেন তিনি। পাশাপাশি তিনি বলেছেন, ভারত এখনই চুক্তি নবায়নের আগ্রহ দেখাবে না। কারণ, ভারত বারেবারে বলে আসছে, কথা হবে সরকার টু সরকার। ফলে যতদিন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে স্থায়ী নির্বাচিত সরকার না হচ্ছে, চুক্তি কতটা হবে তা নিয়েও প্রশ্ন থাকছে।

একই সাথে তিনি মনে করছেন, তারপরও নির্ভর করবে ওই সরকারের সাথে ভারতের কতটা সখ্যতা তৈরি হয় তার উপর ৷ ফলে এখনই কিছু বলা যাবে না। তবে চুক্তির যে পরিবর্তন হতে পারে তা তিনিও মনে করছেন। ফলে গঙ্গা এবং বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি নবায়নের আগে ভারতের পদক্ষেপের ওপরে দুই দেশের সম্পর্ক নির্ভর করবে। তবে তার আগে দেখার, ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের জল কতদূর গড়ায়।

ভিএস/এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।