ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

ত্রিপুরার জলঘেরা প্রাসাদ নীরমহলে কিছুক্ষণ

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৭ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৭
ত্রিপুরার জলঘেরা প্রাসাদ নীরমহলে কিছুক্ষণ ত্রিপুরার জলঘেরা প্রাসাদ নীরমহল/ছবি: ডিএইচ বাদল

ত্রিপুরা (আগরতলা) থেকে ফিরে:  চারদিকে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর ধূ ধূ আকাশ। কোথাও প্রশান্তির বাতাস নেই। এমন একটা নির্জন জায়গা দরকার যেখানে নির্মল বাতাসে প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। শরীরটাকে মুহুর্তে জুড়িয়ে দেবে প্রকৃতির বাতাস। এমন জায়গা পাওয়া হয়তো এখন কল্পনাতীত। পৃথিবীজুড়েই যেখানে মানুষের কোলাহল, সেখানে এমন জায়গা পাওয়া কল্পনায় ছাড়া আর কোথায় সম্ভব!‍

আজ থেকে বহু বছর আগে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ৫৩ কি:মি দূরে সিপাহীজলা জেলার মেলাঘর রুদ্রসাগরে নির্মাণ করা হয় এক অনন্য রাজপ্রাসাদ। যার নাম দেওয়া হয় ‘নীরমহল’।

ত্রিপুরার শেষ রাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুর গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপন করতেন এই নীরমহলে।

নীরমহলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে কোনো কক্ষেই বৈদুতিক পাখা ছিলো না। চারদিকে কারুকাজ করা নয়নাভিরাম এ প্রাসাদের চারপাশ থেকে প্রবাহিত শীতল বাতাসেই এখানে জুড়াত প্রাণমন আর শরীর। সায়র বা বিশাল হ্রদের মধ্যখানে নির্মিত হওয়ায় প্রকৃতির শীতল বাতাসই পরান জুড়িয়ে দিত রাজা-রানীদের।

সিপাহীজল জেলার মেলাঘর রুদ্রসাগরের আয়তন ছিলো ৫ দশমিক ৩ বর্গ কিলোমিটার। আর নীরমহলের আয়তন ৫০০ মিটার। নীরমহলে ছোট বড় ২৪ টি কক্ষ রয়েছে। মেলাঘর থেকে নৌকা বা স্পিড বোটে যেতে হয় নীরমহলে। সায়রের মাঝখানে হওয়ায় এখানে গাড়ি বা পায়ে হেঁটে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো না কোনো কালেই।
ত্রিপুরার জলঘেরা প্রাসাদ নীরমহলে কিছুক্ষণ
পূর্ব-পশ্চিম মুখি বিশাল এই প্রসাদের পাশ্বিমাংশে ছিল অন্দর মহল যেখানে রাজা-রানীরা থাকতেন। এখানে তিন থেকে চারটি নৃত্যঘর রয়েছে। এই নৃত্যঘরের পাশেই রাজাদের শোবার ঘর। কোনো কক্ষেই বৈদুতিক পাখা ছিলো না। এখনও নেই। পূর্ব অংশে ছিলো সৈন্য সামন্তদের থাকার ঘর। এখানেই ছিলো তিনটি জেনারেটির কক্ষ। যেখানে থেকে পুরো প্রাসাদটি আলোকিত করে রাখতো। আর উত্তর পাশে একটি বাথঘাট রয়েছে। এই ঘাটে সাধারণত রাজার কাছে যারা আসতেন এখানে এসেই জাহাজ বা বোট নোঙর ফেলতেন। আর দক্ষিণ পাশ ছিলো শুধুই প্রকৃতির বাতাস প্রবাহিত হওয়ার জন্য। এখানটায় কোনো ভবনও নেই, নেই কোনো স্থাপনা।

মিথ রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভালো বন্ধু ছিলেন রাজা বিক্রম মাণিক্য বাহাদুর। এই নীরমহলটির নামও কবির দেওয়া। এই প্রাসাদে  প্রবেশ করলে মুহূর্তে মন ভালো হয়ে যাবে।

কলকাতার মার্টিন এন্ড বার্ণ নামক একটি নির্মাণ সংস্থা ১৯৩০-১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সময় ব্যয় করেন এই প্রাসাদ নির্মাণে। ১৯৩৮ সাল থেকে প্রাসাদটিতে রাজা অবস্থান করেন। মাঝে মাঝে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রাসাদে এসে অবস্থান করতেন।
ত্রিপুরার জলঘেরা প্রাসাদ নীরমহলে কিছুক্ষণ
পুরো প্রাসাদটি চুন শুরকির দ্বারা নির্মিত। ফ্লোরে রয়েছে ছোট ছোট কালো পাথরের মোজাইক। উপরে উঠার সরু সিড়ি রয়েছে। একেবারে উপরে তিনটি হাওয়া ঘর রয়েছে। এখানে বসে রাজা তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে জোৎসনা রাতে খোলা আকাশে প্রকৃতির ‍বাতাসে আড্ডা মশগুল থাকতেন রাজা বিক্রম মাণিক্যরা। নীরমহলের নিচের অংশ লাল রং এর চুন শুরকি দিয়ে গড়া আর উপরের অংশটি ছিলো দুধ সাদা রং এর।
 
প্রাসাদের ভেতরেই রয়েছে বাগান। প্রাসাদে কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। যেখান থেকে পুরো এলাকাটি দেখা যেত। এছাড়া সৈন্যদের জন্য কতগুলো কম্বুজ রয়েছে। যেখান থেকে প্রসাদারে প্রহরীরা নজর রাখতেন বাইরের শুত্রু থেকে রক্ষা করতে।
 
কিভাবে যাবেন নীরমহলে: আগরতলা থেকে বাস ও ট্যাম্পু ভাড়া করে যাওয়া যেতে পারে। আগরতলা ‍বাসস্ট্যান্ডে খানিক বাদে বাদেই রয়েছে ‍বাস। জনপ্রতি ভাড়া পরবে ৩০ রুপি। আরা ছোট জিপ পাওয়া যায়। একটি জিপে ১২ জন বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে জনপ্রতি ৪০ রুপি গুণতে হবে। দেড় থেকে পৌনে দুই ঘণ্টা সময় লাগে মেলাঘর যেতে। সেখান থেকে ১০ মিনিটের হাটাপথ পেরিয়ে পাওয়া যাবে রুদ্রসাগর উদ্বাস্তু ফিসারম্যার সমবায় সমিতি লি: এর টিকিট ঘর বা বোটঘাট।
ত্রিপুরার জলঘেরা প্রাসাদ নীরমহলে কিছুক্ষণ
রুদ্রসাগর উদ্বাস্তু ফিসারম্যার সমবায় সমিতি লিমিটেড পরিচালিত এই ঘাটে ছোট বড় ৪-৫ বোট রয়েছে। যেখান থেকে বোট বা স্পিড বোট ভাড়া করে মিনিট বিশেক পার হলেই দেখা মিলবে নীরমহল প্রাসাদের। স্পিড ও মোটর বোট ভাড়া (মাথা পিছু ৩ বছরের উর্দ্ধে) ৩০ রুপি, কেউ রিজার্ভ করতে চাইলে (১-১৫ জন) সেক্ষেত্রে ভাড়া হবে ৪৫০ রুপি, গ্রুপে যদি ১৬-২০ জন হয় তাদের রিজার্ভ ভাড়া হবে ৬০০ রুপি, আর ২১-৫০ জনের ভাড়া ১৫০০ রুপি, ৫১-৬০ জনের ভাড়া ১৮০০ রুপি, ৬১-৮০ জনের ভাড়া ২৪০০ রুপি, দেশী নৌকা (মাথা পিছু ভাড়া ৩ বছরের উর্দ্ধে) ৩০ রুপি রিজার্ভ ১-৭ জন ২১০ রুপি।

 এখানেই শেষ নয়। নীরমহলে প্রবেশে জনপ্রতি ১০ রুপি দিয়ে টিকিট নিতে হবে। আর ১২ বছরের নিচে ৫ বছর পর্যন্ত প্রতি জনের ভাড়া ৫ রুপি। আর যারা ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করতে চান তাদের জন্য আলাদা ভাড়া গুনতে হবে।

ডিজিটাল ক্যামেরার জন্য ২০ রুপি, ভিডিও ক্যামেরার জন্য ৪০ রুপি, ট্রাডিশনাল অ্যান্ড ভিডিও ক্যামেরা পেশাগত কাজে ৬০ রুপি, ভিডিও ক্যামেরা পেশাগত কাজে ১৫০ রুপি। পুরো প্রাসাদ ঘোরার জন্য সময় পাবেন মাত্র ৪০ মিনিট। অতিরিক্ত সময়ের জন্য (ঘণ্টাপ্রতি) ১৫০ রুপি।

বাংলাদেশ সময়:০০২৩ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৭
এসএম/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।