ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ মে ২০২৪, ০০ জিলকদ ১৪৪৫

শিক্ষা

৪৪ বছরে ইবি: পিছু ছাড়েনি পুরনো সংকট

তারিকুল ইসলাম, ইবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২২
৪৪ বছরে ইবি: পিছু ছাড়েনি পুরনো সংকট

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, (ইবি): ২২ নভেম্বর। দিনটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য আবেগের।

বয়সের গণ্ডি পেরিয়ে অতীত-বর্তমান শিক্ষার্থী মন এক কাতারে এসে মেলে এদিন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়তে এসে প্রেমে পড়া তরুণ-তরুণীও দিনটির কথা স্মরণ করেন বিভিন্নভাবে। সামাজিক মাধ্যমগুলোয় নিজের প্রিয় শিক্ষালয়কে তুলে ধরেন নতুন করে। কারণ, আজ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন।

বাইশ-দু গুণে ৪৪। আজ ২২ নভেম্বর ইবির ৪৪তম জন্মদিন। ১৯৭৯ সালের এ দিনটিতে যাত্রা শুরু করে স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। দিনটি এলেই উৎসাহ উদ্দীপনার পাশাপাশি গণনা শুরু হয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির। সাবেক-বর্তমান সব শিক্ষার্থীই এ দিনটিতে তাদের ইবি যাত্রার হিসাবের বই খুলে বসেন। খোঁজেন সফলতা-অসফলতার গল্প।

৪৪ বছরের ইবির শৈশব কিন্তু এত মধুর ছিল না। অনেক কষ্ট করে তারুণ্য অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে আজ পুনর্যৌবনে সারা দেশেই আলোচিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুর দিকে নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও আজ ইবি তার নিত্য নতুন প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম। গবেষণা, মুক্ত চর্চা, প্রগতিশীলতা, খেলাধুলাসহ প্রায় প্রতিটি বিভাগে সমানতালে রয়েছে ভালো করার সুযোগ।

এ সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পেরেছে ইবি পরিবারের সদস্যরা? শিক্ষার্থীদের গবেষণাধর্মী বা অনন্য খাতে কতটা সুযোগ করে দিতে পেরেছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা সে হিসাবও কষে ২২ নভেম্বরে।

ক্যাম্পাস নিয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আক্তারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, নিজেকে বুঝতে শেখার পর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করেছি ইবিতে। আমাদের সময় ক্যাম্পাসটা এতটা উন্নত না থাকলেও যতটুকু পেয়েছিলাম তাতেই মনে হচ্ছে স্মরণীয় একটা সময় পার করে আসছি। সময় বদলেছে, সময় এবং চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবর্তনের ধারা। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে যে প্রত্যাশা নিয়ে ক্যাম্পাস গড়ে ওঠার কথা ছিল হয়তো তার অনেকাংশে পূরণ হয়নি। তবে সুযোগ আছে সে প্রত্যাশাগুলো পূরণ করার। আশা করছি নানাবিধ সংকট কাটিয়ে ইবি রোল মডেলে পরিণত হবে।

বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রিজওয়ান আল হাসিব তুহিন বলেন, নিজের পরিবার ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শুরুটা আমার কাছে ছিল বিভীষিকাময়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বন্ধুবান্ধব, পিতৃতুল্য শিক্ষকদের পেয়ে মনে হয়েছে জীবনের প্রকৃত সার্থকতা এখানেই। তাই প্রতিবছর এ দিনটা (২২ নভেম্বর) এলেই ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি কাজ করে। আর সে জায়গা থেকে অনেক কিছু পাওয়া না পাওয়ারও হিসাব তৈরি হয়। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করলে এখনো আমরা পিছিয়ে। তবে পিছিয়ে পড়ার সে কারণগুলো সামনে রেখে সামনে এগিয়ে যাবে প্রিয় ক্যাম্পাস, জন্মদিনে এটাই আমার প্রত্যাশা।

শুরুর দিকে মাত্র দুটি অনুষদের অধীনে চারটি বিভাগ ছিল কুষ্টিয়ায় অবস্থিত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ছিল মাত্র ৩০০ শিক্ষার্থী। বর্তমানে ৩৬টি বিভাগের অধীনে প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে এ বিদ্যায়তন।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ফেলে আসা ৪৩ বছরে অনেক প্রত্যাশাই পূরণ হয়নি এখনও। ৪৪ বছরে এসেও পিছু ছাড়েনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো সংকট।  এসব সংকটের শুরুতেই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ব্যবস্থা। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সম্পূর্ণ আবাসন ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল। কিন্তু, আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারায় প্রতিষ্ঠার চারদশকেও প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ জনশক্তিই অনাবাসিক।

বর্তমানে ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য যথাক্রমে পাঁচটি ও তিনটি আবাসিক হল রয়েছে। সেখানে মাত্র ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন। বাকি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী ও কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ শহরের মেস ও বাসা ভাড়ায় থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো আরও এক সংকটের নাম পরিবহন খাত। আবাসন ব্যবস্থা কম থাকায় গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবহন সেবাও। এ খাতে বছরে ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়। শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য নিজস্ব গাড়ি বাদেও দুই জেলা থেকে ৩২টি ভাড়ায় চালিত গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে।

এসব বাহনের পেছনে বছরে ব্যয় হয় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা। এত ব্যয় হলেও পরিবহন সেবা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। বিভিন্ন সময় ফিটনেসহীন বাহন, গাড়ি ও চালকদের লাইসেন্স, চালক-হেলপারদের দুর্ব্যবহারসহ অসংখ্য অভিযোগ আছে শিক্ষার্থীদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় সংকটগুলোর মধ্যে অন্যতম গবষেণা খাত। তুলনামূলক হারে বিভাগ বাড়লেও বাড়ছে না গবেষণা। এর পেছনে অপ্রতুল বরাদ্দকে দায়ী করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৫৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকার বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এ বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যা মোট বাজেটের ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। যা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবীকৃত ২০০ কোটি ১৪ লাখ টাকার বিপরীতে কমিশন নিজস্ব আয় ৮ কোটি ১ লাখ টাকাসহ ১৫৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবীকৃত ২১০ কোটি ৪০ লাখ টাকার বিপরীতে নিজস্ব আয় ৯ কোটি সহ কমিশন ১৫৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

এ বাজেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যা মোট বাজেটের ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। যার ভেতর গবেষণা (নিয়মিত) ৯০ লাখ টাকা যা মোট বাজেটের ০ দশমিক ৫০ শতাংশ, গবেষণা (বিশেষ) ৫০ লাখ টাকা যা মোট বাজেটের ০ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং উদ্ভাবনে ২ লাখ টাকা যা মোট বাজেটের ০ দশমিক ১১ শতাংশ।

এছাড়া শ্রেণীকক্ষ, ল্যাব, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায়ও সে পুরনো দিনের সংকট চলমান। শিক্ষক, কর্মচারী সংকটসহ নানা সমস্যা প্রতিনিয়তই ঘিরে ধরছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এসব নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আলোচনা-সমালোচনা চলে সমানতালে।

নানাবিধ সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে জায়গা থেকে অনেকটাই বিচ্যুত। তারপরও চাহিদা সম্পন্ন অনেক বিভাগ চালু করায় একাডেমিক গতি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা সুনামের সাথে বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি দুই শহরের মাঝামাঝি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমস্যা হয়। দূরত্বের কারণে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক অনেক কাজই ব্যাহত হয়। দুই শহর থেকে ২৪ ও ২২ কিলোমিটার দূরত্ব হওয়ায় ক্যাম্পাস পরিবহন নির্ভরশীল। সম্পূর্ণ আবাসিক হওয়ার কথা থাকলেও সে জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা সংকট। তবে, নতুন হলগুলো হয়ে গেলে আবাসিক সংকট কিছুটা কাটবে। এরপরও একটা প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বেশ সাফল্য আছে। সংকটগুলো হয়তো পুরোপুরিভাবে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। তবে মেজর সমস্যাগুলো সমাধান হলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, আমাদের বেশকিছু সংকট রয়েছে সত্য। আবাসন ব্যবস্থা, বিভাগে শিক্ষক সংকটসহ বড় কিছু সংকট চলমান। এসবের উন্নয়নও চলছে। আমরা এসব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।

পুরনো-নতুন সংকটের ভেতর দিয়েই আশার আলো দেখেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবারের প্রতিটি সদস্য। ভোরের আলো আসার সাথে চোখের সামনে ভেসে ওঠা নানাবিধ সংকট, বেলা বাড়ার সাথে সাথে সম্ভাবনার প্রতিটি তত্ত্ব দিয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই যেন সমাধান করা যায়, সে আশাই করেন সবাই। আগামী দিনের সূর্য যেন নব উদ্যমে উদয় হয়, ইবির ৪৪তম জন্মদিনে এমন প্রত্যাশা করেছেন সাবেক বর্তমান সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২২
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।