ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

স্বজনদের অভিযোগ খুন

চট্টগ্রামে স্বামী-স্ত্রীর ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১৪
চট্টগ্রামে স্বামী-স্ত্রীর ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানার পূর্ব ফিরোজ শাহ এলাকায় স্বামী-স্ত্রী’র অস্বাভাবিক ও রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে।



নিহতরা হলেন, রাজিব চৌধুরী (৪২) ও সঞ্চিতা শীল চৌধুরী (৩৫)। রাজিব নগরীর ফিরোজ শাহ কলোনি সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এবং স্ত্রী চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে খাদ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিদর্শক পদে কর্মরত আছেন।


পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, ফুল তুলতে গিয়ে তিনতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে সঞ্চিতার মৃত্যু হয়েছে। আর নিচে থাকা স্বামীর মাথায় ইট পড়ে গুরুতর জখম হয়ে মারা গেছেন।

আর নিহতের পরিবারের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, রাজিব ও সঞ্চিতাকে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে এবং বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে এ নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কারও বিরুদ্ধে কোন তথ্য দিতে পারেনি নিহতের স্বজনরা।

তবে প্রত্যক্ষদর্শী গৃহপরিচারিকা সুপ্তি পাল (৪০) পুলিশ-র‌্যাব কর্মকর্তা এবং উপস্থিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাজিব বাড়ির আঙিনায় একটি প্লাস্টিকের চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে গাছ থেকে পূজার ফুল তুলছিলেন। ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে একটি গামারি গাছ থেকে ফুল হাতে ছিঁড়ে প্লাস্টিকের বাটিতে নিচ্ছিলেন সঞ্চিতা।

এসময় হঠাৎ ছাদের আড়াই ফুট লম্বা সীমানা দেয়াল ভেঙ্গে নিচে পড়ে যান সঞ্চিতা। দেয়ালের ভাঙ্গা ইট এসে পড়ে রাজিবের মাথায়। রাজিব তখন আঙিনায় পড়ে থাকা ফুল কুড়াচ্ছিলেন। এ ঘটনা দেখতে পেয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠেন সুপ্তা। এরপর স্থানীয় লোকজন দ্রুত জড়ো হন। আহতদের সিএনজি অটোরিক্সায় করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে দায়িত্বরত এএসআই পংকজ বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, ভোর সাড়ে ৬টার দিকে গুরুতর আহত অবস্থায় দু’জনকে হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেছেন।

তবে সুপ্তা পাল এ বর্ণনা দেয়ার সময় একদম স্বাভাবিক দেখা গেছে। নিহত সঞ্চিতার ছোট ভাই তড়িৎ শীল বাংলানিউজকে বলেন, সুপ্তা’র কথা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছেনা। সে একেক সময় একেক কথা বলছে। আমার বোন অনেকবার বলেছিল, সুপ্তা তার কথা শুনেনা। গতকাল (বুধবার) রাতেও সুপ্তা আমার বোনের সঙ্গে ঝগড়া করেছিল।

নিহতের বড় মেয়ে আট বছর বয়সী অক্ষয়া চৌধুরী অর্পা বাংলানিউজকে বলেন, ওর (সুপ্তা) কান্না আর চিৎকার শুনে আমি জেগে উঠি। আমি নিচে গিয়ে দেখে তাড়াতাড়ি আমার মেঝ মাসিকে ফোন করি।

শিশু অর্পাও অভিযোগ করেন, সুপ্তা পাল বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে সুপ্তা এ অভিযোগের প্রতিবাদ জানান।

নিহতের স্বজনেরা জানান, নগরীর আকবর শাহ থানার অদূরে পূর্ব ফিরোজ শাহ এলাকার বিশ্ব ব্যাংক আবাসিক এলাকার এক নম্বর সড়কের এম-ব্লকে প্রায় চার বছর আগে জায়গাটি কিনে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন রাজিব। একই এলাকায় স্কুল হওয়ায় এবং ব্যাচ পদ্ধতিতে পড়ানোর কারণে এলাকায় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন এ শিক্ষক।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, আঙিনায় টিনের ঘেরা দেয়া একটি ঘর আছে। টিনের মধ্যে রক্তের দাগ, আঙিনায় রক্তের ধারা দেখা গেছে। আঙিনায় ছড়িয়ে, ছিটিয়ে আছে প্রায় ১৫ টি ইট। টিনের ঘরের একাংশও সামান্য বিধ্বস্ত দেখা গেছে।

সকালে এ ঘটনা জানাজানি হবার পর থেকে শত, শত মানুষ, নারী-পুরুষ ওই বাড়িতে ভিড় করছিল। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুতে ফিরোজ শাহ কলোনি সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ছুটি দেয়া হয়েছে। সেখানকার শিক্ষার্থীরাও ওই বাসায় এসে অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন, অনেকে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন রাজিব ও সঞ্চিতার দু’শিশু কন্যার দিকে।

ওই বাসায় সুপ্তার কোলে ছিল রাজিব ও সঞ্চিতার তিন বছরের মেয়ে আদৃতা। তার হাতে কেউ একটি বাবা-মায়ের ছবি ধরিয়ে দেয়। আদৃতা বুঝতেও পারছেনা তার বাবা-মা আর বেঁচে নেই। বড় বোন অর্পা সবকিছু বুঝলেও ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকটা হতভম্ব। মাঝে মাঝে কথা বললেও অনেক কিছুই সে গুছিয়ে বলতে পারছিল না।

রাজিব আর সঞ্চিতার শয়নকক্ষে বসে ছবি দেখে কাঁদছিল সঞ্চিতার ছোট ভাই তড়িৎ আর তার স্ত্রী। তড়িৎ বলল, আমার বোনদের কোন শত্রু ছিলনা। সবাই তাদের খুব ভালবাসত।

তড়িৎ শীল বাংলানিউজেকে বলেন, আমার বক্তব্য হচ্ছে, যদি ছাড় থেকে পড়ত তাহলে শুধু মাথায় জখম হত। আমার বোনের হাতের রগ কাটল কিভাবে ? রাজিব দাদার পায়ের রগ কাটা কেন ? মনে হচ্ছে কেউ পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে খুন করেছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে চমেক হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা গেছে, দু’জনের মাথা থেতলানো অবস্থায় আছে। দু’জনের চেহারাই প্রায় বিকৃত হয়ে গেছে। সঞ্চিতার হাত-পা অস্বাভাবিক ফোলা দেখা গেছে। তবে হাতে জখমের কোন চিহ্ন দেখা যায়নি। আর রাজিবের মাথায় মারাত্মক জখমের পাশাপাশি মাথায় কুপিয়ে আঘাতের মত চিহ্ন দেখা গেছে।

মর্গের সামনে বসে বিলাপ করছিলেন সঞ্চিতার মা কল্পনা শীল, রাজিবের ছোট ভাই অভিজিৎ চৌধুরীসহ নিহতের স্বজনরা।

বৃদ্ধা কল্পনা শীল বাংলানিউজকে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি সকালে ঘুম থেকে উঠেছি। আমাকে বলেছে তোমার মেয়েকে মেরে ফেলেছে। আমাকে গাড়ি করে নিয়ে এসেছে।

তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, অ-ঝি, আঁরে মা হনে ডাকিব ? আঁই মইরলে হনে কাঁদিব ? (আমাকে মা কে ডাকবে ? আমি মরলে কান্না করবে কে ? )

সঞ্চিতার পিসি রূপনা শীল বাংলানিউজকে বলেন, সঞ্চিতা সবসময় বলত, বেশি ছাত্র পড়িয়ে বেশি টাকা আয় করায় এবং বিল্ডিং বানানোর পর মানুষ তাদের হিংসা করত। আমরা বিশ্বাস করিনা, ছাদ থেকে পড়ে তারা মারা গেছে। তাদের মেরে ফেলা হয়েছে।

নিহত রাজিবের ছোট ভাই অভিজিৎ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আমার জানামতে আমার ভাইয়ের কোন শত্রু ছিলনা। এখন পুলিশ তদন্ত করে দেখুক, কারা এতবড় ঘটনা ঘটাল। আমরা তো আর ভাইকে ফিরে পাবনা। ভাই হত্যার বিচার চাই।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (পশ্চিম) এস এম তানভির আরাফাত, ডবলমুরিং জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার হাসান মোল্লা এবং র‌্যাবের সহকারী পরিচালক সুজ্ঞান চাকমা।

এস এম তানভির আরাফাত বাংলানিউজকে বলেন, প্রত্যক্ষদর্শী ‍সুপ্তা পালের বক্তব্য আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। এরপরও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে কি আসে সেটা দেখব। হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ যেহেতু উঠেছে, মামলা দায়েরের পর সেই বিষয়ে তদন্ত হবে।

নিহত রাজিব শীল ফটিকছড়ি উপজেলার পাঁচপুকুরিয়া গ্রামের মৃত আদেশ চৌধুরীর ছেলে। আর সঞ্চিতার বাবার বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের সরকারহাট এলাকায়।

বাংলাদেশ সময়: ১০২০ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।