চট্টগ্রাম: দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী চট্টগ্রাম আদালতে তিন দফা জঙ্গী বোমা হামলার ঘটনায় বোমা মিজানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া তিনটি মামলার বিচার আট বছরেও শেষ হয়নি। সাক্ষী হাজির করতে না পারায় কার্যত গত তিন বছর ধরে এসব মামলার বিচার থমকে আছে।
শুধু এ তিনটি মামলা নয়, জেএমবির বোমা হামলা কিংবা জঙ্গীদের কাছ থেকে বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের হওয়া কোন মামলার দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি গত পাঁচ বছরে হয়নি। অভিযোগ আছে, চাঞ্চল্যকর এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে আগ্রহ নেই রাষ্ট্রপক্ষের।
তবে রোববার বোমা মিজানকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে ফিল্মি স্টাইলে ছিনিয়ে নেয়ার পর এখন বোধোদয় হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলীদের।
বোমা মিজানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে বিচারাধীন মামলাগুলো সর্বশেষ কি অবস্থায় আছে সে সম্পর্কে কোন তথ্যও নেই রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুলী চট্টগ্রাম মহানগর পিপি কামাল উদ্দিন আহমদের কাছে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি কাল (সোমবার) সকালেই জেএমবি’র সব মামলার রেকর্ড তলব করব। তারপর মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে যা পদক্ষেপ নিতে হয় তা-ই নেব।
মহানগর পিপি বলেন, ‘দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে জেএমবি’র বোমা হামলার মামলাগুলো নজর এড়িয়ে গেছে। ’
২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পুলিশ চেক পোস্টের সামনে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলে মারা যান পুলিশ কনস্টেবল রাজীব বড়ুয়া ও ফুটবলার শাহাবুদ্দীন। আহত হন পুলিশ কনস্টেবল আবু রায়হান, সামসুল কবির, রফিকুল ইসলাম, আবদুল মজিদসহ ১০ জন। এ ঘটনায় কোতয়ালী থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি বর্তমানে চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন আছে।
একই বছরের ৩ অক্টোবর দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে চট্টগ্রাম আদালতের তৎকালীন দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন এবং তৎকালীন মহানগর হাকিম আকরাম হোসেনের এজলাসে জেএমবি জঙ্গিরা আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। এ ঘটনায় কোতয়ালী থানায় দায়ের হওয়া পৃথক দু’টি মামলা বর্তমানে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিচারাধীন আছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ তিনটি মামলা সহ চট্টগ্রামে জাহিদুল ইসলাম প্রকাশ সুমন প্রকাশ মিজান প্রকাশ বোমারু মিজানের বিরুদ্ধে মোট ৬টি মামলা বিচারাধীন আছে। এছাড়া ঢাকায় হুমায়ন আজাদ হত্যাচেষ্টা মামলাসহ তিনটি মামলা বিচারাধীন আছে। জামালপুর ও সাতক্ষীরায় পৃথকভাবে দু’টি মামলা বিচারাধীন আছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে বিচারাধীন ৬টি মামলার মধ্যে পুলিশ হত্যা ও বিচারকের এজলাসে বোমা ছুঁড়ে মারার মামলা তিনটিতে ২০১১ সালের পর আর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। বাকি তিনটি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ স্তিমিত হয়ে গেছে এর আগেই।
পুলিশ হত্যা মামলায় দীর্ঘদিন ধরে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় ২০১৩ সালের ২১ জুলাই চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ওইদিন বিচারক এক আদেশে উল্লেখ করেন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১(২) ধারা অনুযায়ী সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষীর অভাবে মামলা প্রমাণ করা না গেলে দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে বহন করতে হবে।
২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালতের পুলিশ চেকপোস্টে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ২০০৬ সালের ১৮ মে নগর গোয়েন্দা পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়।
এতে জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমান্ডার জাবেদ ইকবাল ওরফে মোহাম্মদ ও বোমা তৈরির কারিগর জাহিদুল ইসলাম সুমন ওরফে বোমা মিজানকে আসামি করা হয়। ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট মামলাটির বিচার শুরু হয়। ৭৭ জন সাক্ষীর মধ্যে গত সাত বছরে মাত্র ২৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। আগামী ১৯ মার্চ এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের সময় নির্ধারিত আছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর পিপি অশোক কুমার দাশ বাংলানিউজকে বলেন, ২০১১ সালে এ মামলায় সর্বশেষ সাক্ষী হয়েছে। এরপর হরতাল-অবরোধের কারণে আর সাক্ষীরা আসতে পারেননি। এছাড়া সাক্ষীদের সমন যথানিয়মে পৌঁছাতে পুলিশেরও কিছুটা গাফেলতি আছে। কারণ যারা সাক্ষ্য দিতে আসছেন না তাদের অধিকাংশই পুলিশ।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেক সময় সাক্ষীর স্থায়ী ঠিকানা অভিযোগপত্রে কিংবা এজাহারে লেখা থাকেনা। সেজন্য তাদের খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে যারা সাক্ষ্য দিতে আসছেন না তাদের মধ্যে শুধু পুলিশ নয়, সাধারণ পাবলিকও আছে। ’
২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম আদালতের দুই বিচারকের এজলাসে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনায় নগরীর কোতোয়ালি থানায় বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। এসব মামলায় আবদুল মালেক লাল্টু ওরফে আনাছ, শাহাদাত আলী, জাবেদ ইকবাল ওরফে মোহাম্মদ, মিজান ওরফে জাহিদুল ইসলাম সুমন ওরফে বোমা মিজান, শায়খ আবদুর রহমান ও আতাউর রহমান সানির নামে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা এম এ কালাম। ২০০৭ সালের ২৫ জুলাই এসব মামলায় অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
আদালত সূত্র জানায়, মহানগর হাকিম আকরাম হোসেনের এজলাসে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সর্বশেষ ২০১০ সালের ১৬ মার্চ ওই হাকিম সাক্ষ্য দেন। যুগ্ম জেলা জজ সৈয়দ দিলজার হোসেনের এজলাসে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সর্বশেষ গত ২০১১ সালের ২৭ জুন সাক্ষ্যগ্রহণ হয়।
মামলা দুটি মুখ্য মহানগর হাকিম মশিউর রহমান চৌধুরীর আদালতে বিচারাধীন আছে। আগামী ৫ মার্চ মামলা দু’টির পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের সময় নির্ধারিত আছে।
তবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পিপি আইয়ূব মিয়া বাংলানিউজকে জানান, বোমা মানিকের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন চারটি মামলা নিষ্পত্তি করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব মামলার মধ্যে নগরীর কোতয়ালী থানার একটি মামলায় তার ২৬ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। কক্সবাজারের তিনটি মামলায় ট্রাইব্যুনাল তাকে পৃথকভাবে মোট ১৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, বোমা হামলা, বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের হওয়া চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার চারটি, খুলশী থানার ৩টি, কোতয়ালী থানার ৬টি, বন্দর থানার ৩টি, পাঁচলাইশ থানার ৩টি, ডবলমুরিং, পাহাড়তলী, হালিশহর, বাকলিয়া থানার একটি করে মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে।
আসামী আনা-নেয়ায় পুলিশের বিশেষ এসকর্ট
চট্টগ্রাম কারাগার থেকে আদালতে আসামী আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ এসকর্ট ব্যবস্থা চালু করেছে নগর পুলিশ। রোববার বোমা মিজানকে ছিনিয়ে নেয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে এ ব্যবস্থা চালু করে পুলিশ।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (এডিসি-প্রসিকিউশন) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বাংলানিউজকে জানান, আসামীদের বহনকারী প্রিজন ভ্যানগুলো আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে এসকর্ট টিম দিয়ে আলাদা গাড়ির মাধ্যমে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। এসকর্ট টিমে প্রাথমিকভাবে সাতজন সদস্য দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ময়মনসিংহের ঘটনার পর পুরো আদালতের নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে, হাজতে জঙ্গী এবং জামায়াত-শিবিরসহ স্পর্শকাতর মামলার আসামীদের বিশেষ নজরদারিতে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও এডিসি-প্রসিকিউশন জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৯ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩,২০১৪