চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: দেশের উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক এলাকায় প্রায় ১৯ হাজার নৌকা ও ট্রলার থেকে বছরে ৪০ হাজার ১১০ মেট্রিক টন প্লাস্টিকের জাল ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার হয়ে থাকে। যার মধ্যে ২ হাজার ৭৪০ মেট্রিক টন তথা ৭ শতাংশই সমুদ্রে ফেলে যায় জেলেরা।
সমুদ্রের তলদেশে থাকা এই ভুতুড়ে জাল দেশের উপকূলে যেমন পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, তেমনি অব্যবহৃত জালগুলো ভেঙে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক।
একটি ছোট্ট সমীকরণ দেখলেই আঁচ করা যাবে এর ভয়াবহতা। গবেষকরা বলছেন- গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী হয়ে প্রতিদিন ১-৩ বিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করছে বঙ্গোপসাগরে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের নেতৃত্বে একদল গবেষক এই ভয়াবহ দূষণ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় কাজ করছেন। প্লাস্টিক জালের দূষণ সম্পর্কে তারা যেমন জেলেদের সচেতন করছেন, তেমনি পরিত্যক্ত জাল থেকে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির মাধ্যমে বর্জ্যকে রূপান্তর করছেন বাণিজ্যিক সম্ভাবনায়।
বিশ্ব ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘প্লাস্টিক ফ্রী রিভারস অ্যান্ড সিজ ফর সাউথ এশিয়া (প্লিজ)’ প্রকল্পের আওতায় ‘ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসেজ (ইউএনওপিএস)’ ও ‘সাউথ এশিয়া কোপারেটিভ এনভায়রনমেন্ট পোগ্রাম (এসএসিএপ)’ এর তত্ত্বাবধানে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন তারা।
৮ সদস্যের গবেষক দলে রয়েছেন- চবির মেরিন সাইন্সেস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আলাউদ্দিন মজুমদার, মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর, মেরিন সাইন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এসএম শরিফুজ্জামান, অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন, সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শাহ নেওয়াজ চৌধুরী, প্রভাষক ইশতিয়াক আহমাদ চৌধুরী এবং নাইনা ইসলাম। এছাড়াও মেরিন সাইন্সেস ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা এই গবেষণায় সহযোগী হিসেবে ছিলেন।
গবেষকরা জানিয়েছেন, যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে চট্টগ্রাম নগরে বছরে ৭০ হাজার ৮৩৩ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য নালা, নর্দমা, খাল এবং জলাশয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পাশাপাশি কর্ণফুলি নদীতে ভয়ংকর দূষণ সৃষ্টি করছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলি নদীতে ২-৭ মিটার পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তর সনাক্ত করেছে। যা ড্রেজিংয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই চট্টগ্রাম নগরে প্লাস্টিক দূষণ রোধে প্লাস্টিকের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে প্রশিক্ষণের আয়োজন ও উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার পরিকল্পনা করেছে গবেষক দলটি।
মঙলবার (০৬ মে) নগরের কাজীর দেউড়ীর হোটেল রেডিসন ব্লু’তে ‘মাল্টি স্টেকহোল্ডার কনসাল্টেশন ওয়ার্কশপ অন প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ইন চিটাগং সিটি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে গবেষকরা তাদের কার্যক্রম তুলে ধরেন। এতে ৯টি স্কুলের শিক্ষার্থী, জেলে পল্লির নারীরা এবং প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা ২৭টি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। নজর কেড়েছে বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তোলন করা পরিত্যক্ত জালের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কোনো রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট শাখা নেই। তাই আমাদের অন্যের গবেষণার ওপর নির্ভর করতে হয়। আশাকরি এই গবেষণাটি আমাদের কাজে আসবে। আমরা এই ধরনের গবেষণাকে উৎসাহিত করি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে প্রতিদিন ৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। আমরা কেবল এর মধ্যে ৩০ শতাংশ বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে পারি। চট্টগ্রামের অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতার পেছনেও এই প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনাই দায়ী। বাংলাদেশের কোথাও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। আমরা এখনও আগের মতোই ময়লা ফেলার জন্য ভাগাড়টাই ব্যবহার করি। পরিবেশ আইনে প্লাস্টিক নিষিদ্ধের ব্যাপারে বলা হলেও আমরা সেটা প্রয়োগ করতে পারছি না। তবে সিটি করপোরেশন এখন নানান উদ্যোগ নিচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কাজও চলছে। তবে সবাই যদি নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন হতে না পারি, তাহলে এখান থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই।
চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক এসএম নসরুল কদির বলেন, আমরা সবাই যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তাহলে চট্টগ্রাম শহরটা হবে সবুজ, স্বাস্থ্যকর ও মানসম্মত শহর। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নত করতে হলে সামাজিকভাবে সচেতন হতে হবে। ভাঙাড়ি থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী সবাইকেই সচেতন করতে হবে। আমরা সবাই পরিবেশের ক্ষতির জন্য দায়ী। গবেষকদের তথ্য উপাত্ত দেখে মনে হলো- আমি নিজেও এর জন্য দায়ী।
গবেষক দলের প্রধান চবির মেরিন সাইন্সেস ও ফিশারিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমরা গত ১০ থেকে ১১ মাস চট্টগ্রাম শহরের অনেক স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কাজ করেছি। আমাদেরকে সিটি করপোরেশন অনেকভাবে সহযোগিতা করেছে। ৯টি স্কুলের প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে কাজ করেছে। যারা সেই স্কুল থেকে বাছাই হতে হতে আজকের প্রোগ্রাম পর্যন্ত এসেছে, আশাকরি তারা অনেক দূর যাবে। ছাত্রছাত্রী এবং উদ্যোক্তারা প্রদর্শনীর মাধ্যমে আজ সেই সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরেছে, সেটাই আমাদের আশান্বিত করছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চবির মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এসএম নসরুল কদির, বিশেষ অতিথি ছিলেন চসিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, চবির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-আমীন, মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর, ফিশারিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আশরাফুল আজম খান, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মজুমদার, মেরিন সায়েন্সেস ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. এসএম শরিফুজ্জামান, ড. মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ চৌধুরী, ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০২৫
এমএ/টিসি