দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে না পারলে দেশ আরও সংকটের মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন। পাশাপাশি আলোচিত গণভোটকে সিপিবি অপ্রয়োজনীয় মনে করছে বলেও তিনি জানান।
গত ১১ অক্টোবর সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ জহির চন্দন এসব কথা জানান। এ সময় তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচন নিয়ে জনগণের সংশয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য, সিপিবির নির্বাচনী প্রস্তুতি ও বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি নিয়ে বৃহত্তর ফ্রন্ট বা বাম বলয় গঠনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ জহির চন্দন খোলামেলাভাবে নিজের মতামত ও কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান তুলে ধরেন। সিপিবির নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। সারা দেশে যারা প্রার্থী হবেন তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এই মাসের মধ্যেই আমাদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে পারব। বাম জোটের দলগুলো তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করবে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থিতা নিয়ে আলোচনা শুরু করব। প্রথমে সিপিবির প্রার্থী তালিকা, বাম জোটের প্রার্থী তালিকা তারপরে বাংলাদেশ জাসদ, ফ্যাসিবাদবিরোধী মঞ্চ, গণফোরাম, ঐক্য ন্যাপ সবার সঙ্গেই আলোচনা করব। নির্বাচনকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধকে যারা মানে, এই ধরনের সকল বাম, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল শক্তি ও ব্যক্তি এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, দলিত, আদিবাসী, সুফিবাদে যারা বিশ্বাস করে—এই ধরনের যত সংগঠন আছে, চা শ্রমিক, মানে এই ধরনের যারা তলার মানুষ, তাদের যে সংগঠন আছে, সেসব সংগঠনের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি, আলোচনা অব্যাহত রেখেছি। আলোচনা করে একটা বৃহত্তর ফ্রন্ট, যেটার নেতৃত্বে থাকবে বাম গণতান্ত্রিক শক্তি। সেই বৃহত্তর ফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রসেসটা আমরা নিয়েছি। নির্বাচনে যেমন বিএনপির একটা বৃহত্তর বলয় থাকবে, জামায়াত ও ইসলামিক দলগুলোর একটা বলয় থাকবে, তেমনি আমরা একটা বলয় তৈরি করতে চাই। আমাদের এই বলয়ে আমরা তলার মানুষের ওপর নির্ভর করছি এবং এইভাবে আমরা অগ্রসর হব।
কবে নাগাদ এই বৃহত্তর ফ্রন্ট আত্মপ্রকাশ করবে জানতে চাইলে সিপিবি সভাপতি বলেন, আগামী ৩০ অক্টোবর একটা কনভেনশন আছে ঢাকায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কনভেনশন। এখানে আদিবাসী, দলিত, হরিজন, সুফিবাদে বিশ্বাসী, চা শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক—এ ধরনের যত সংগঠন আছে সবাইকে নিয়ে, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে এই কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। আর একটা আলোচনা আছে—এই কনভেনশনের পর সেখান থেকে একটা চার্টার তৈরি করে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সংগঠনগুলোকে নিয়ে আরেকটি কনভেনশন করার চিন্তা আছে। আলোচনা চলছে, মূল কথা আমরা একটা বৃহত্তর শক্তি গড়ে তুলতে চাই। অবশ্যই যারা মুক্তিযুদ্ধকে মানে তাদের নিয়ে, এখানে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। এটা নির্বাচনী ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করবে, পরবর্তীতে এটাকে নিয়ে কী করা যায়, সেই চিন্তা-ভাবনা করা হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠে বিভিন্ন কথা শোনা যায়। যে সময়ে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে নির্বাচন হবে কি না জানতে চাইলে সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, এখনো পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে মনে হয়। কারণ আমাদের দেশে পলিটিক্যাল সিচুয়েশন যে জায়গায় যাচ্ছে, দ্রুত একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে না পারলে দেশটা আরও সংকটের মধ্যে পড়ে যাবে। এমনিতেই সংকট চলছে, এটা সবাই আমরা জানি। এই বিবেচনা থেকে মনে হচ্ছে নির্বাচনটা হবে, আমরা এই জায়গাটায় আশাবাদী। আমরা রাজপথে আছি—নির্বাচনটা যেন দ্রুত সময়ে হয়, সেই দাবি নিয়ে। মানুষের মধ্যে সংশয়, এটা স্বাভাবিক। কারণ একেকজনের একেক ধরনের বক্তব্য। তবে এখনো দেখতে পাচ্ছি, প্রধান উপদেষ্টা বা তার উপদেষ্টা পরিষদ বলে যাচ্ছে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বা দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেখা যাক কী হয়।
নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয়ের কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংসয়ের একটা বড় কারণ হলো—প্রথমত এটা একটা অন্তবর্তীকালীন সরকার, এই সরকারের কাছে চাওয়া পাওয়ার আমাদের কিছু নাই। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল এবং আছে সেটা হলো—একটা অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাওয়া বা সরে যাওয়া—এটাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু এখানে নানা ধরনের ফোর্স, নানা ধরনের শক্তি দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ফলশ্রুতিতে যেটা হচ্ছে, মানুষের মধ্যে সব সময় মনে হচ্ছে... আমার ধারণা এই সংশয়গুলো রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই মানুষের মধ্যে চলে আসছে— এটা হলো বাস্তবতা। অন্তর্বর্তী সরকার ও বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিভিন্ন ভাবাদর্শের রাজনৈতিক দল সবার যে অবস্থা চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে এই কনফিউশন তৈরি হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সংশয় জন্ম নেওয়ার একটা কারণ হলো, বর্তমান সরকার ও তার চারপাশে যারা আছেন তাদের অ্যাক্টিভিটিজ বা কার্যক্রম সেইটার ভিত্তিতে।
জুলাই সনদ প্রসঙ্গে সিপিবির সভাপতি বলেন, প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে ঐকমত্য কমিশনের সভায় আমাদের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছেন। ওখানে ৮৪টি বিষয় এসেছিল মতামতের ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব যেগুলো ছিল, সেগুলোতে একমত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নমত দিয়েছি, নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি। তবে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, যেটা আমরা বলেছি বারবার—যতটুকু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, ততটুকু বিষয় নিয়েই জুলাই সনদ হওয়া উচিত। ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট যেগুলো আছে, সেগুলোকে আপাতত বাইরে রাখেন, এটা আমাদের প্রস্তাবনা। দ্বিতীয়ত আমরা বলেছি—জুলাই সনদ আপনারা করছেন, সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে এবং ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতির প্রশ্নে, এটাকে যদি বিকৃত করা হয় কিংবা বাদ দেওয়া হয়, আমরা এই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব না। খুব পরিষ্কারভাবে এটা বলে এসেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে—এই ধরনের কোনো বিষয়ের সাথে আমরা থাকছি না। এগুলো যদি বিকৃত হয় তবে আমরা স্বাক্ষর করব না।
এগারোটা কমিশন হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপারে কোনো কমিশন হয় নাই। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ, যারা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে একটা ভাইটাল রোল প্লে করল, যারা শহীদ হলো তাদের বিষয়ে কোনো কমিশন করা হয়নি। সংবিধান নিয়ে টানা-হেঁচড়া করা হয়েছে। আমরা বারবার বলার চেষ্টা করছি, এখনো বলি— ৭২-এর সংবিধান সংশোধন হতে পারে, কিন্তু পুনঃলিখন বা পরিবর্তন করা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব না। আগামী দিনে যে জাতীয় সংসদ আসবে, তারাই নির্ধারণ করবে কীভাবে প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। এটা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব না।
গণভোট প্রসঙ্গে সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, আমরা বলেছি গণভোট অপ্রয়োজনীয়। আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য—আমরা গণভোটকে অপ্রয়োজনীয় মনে করি।
কেন অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথমত ঐকমত্য কমিশনে যে সমস্ত বিষয়ে একমত হয়ে গেছে, সেগুলোতে আর গণভোটের প্রয়োজন হয় না। আমাদের সংবিধানের কোথাও গণভোটের প্রভিশন নাই এবং আমাদের গণভোটের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আমরা জিয়াউর রহমানের আমলের গণভোট দেখেছি, এরশাদের আমলের হ্যাঁ/না ভোট দেখেছি। আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে—এই গণভোটগুলো করা হয় শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এবং তারা যে লক্ষ্য নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য। এখানে আমাদের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কোনো আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নাই। আমরা বলেছি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ—এই চার মূলনীতি সংবিধানে থাকতে হবে। তার সাথে যদি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় যেটা আছে—স্বাধীনতা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার যুক্ত করতে পারেন। কিন্তু ওইটাতে হাত দিতে পারবেন না।
দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সিপিবি সভাপতি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না। একটা সিস্টেম দাঁড়াতে হবে, নির্বাচিত সরকার না আসলে কোনো সিস্টেম দাঁড়াবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না। একটা নির্বাচিত সরকার এলে উন্নতি হবে। নির্বাচিত সরকারকে নিজের স্বার্থে, নিজের জন্যই, নিজেকে জনপ্রিয় রাখার জন্যই এগুলো করতে হবে। আর সমাজের একটা আমূল পরিবর্তন করা না গেলে এটার স্থায়ী সমাধান হবে না। এই কাজটা কমিউনিস্ট, বামপন্থি, প্রগতিশীল শক্তির সরকার করতে পারে।
দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, দ্রব্যমূল্য কখনো বাড়ে কখনো স্থিতিশীল হয়। কিন্তু আমরা বহু বছর ধরে দেখে আসছি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম লুটেরা ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিচ্ছে। যারা দেশ চালিয়েছে বা এখন যারা চালাচ্ছে সবাই একটা লুটেরা ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। তার সাথে সম্পর্কিত সবাই, সিন্ডিকেট তৈরি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। সিন্ডিকেট ভাঙতে পারে, এটা নির্ভর করে সরকারের চরিত্রের ওপর। তাদের শ্রেণির ওপর নির্ভর করে দেশটা কীভাবে চলবে।
এই সরকার সিন্ডিকেট কেন ভাঙতে পারছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, পারবে না, কারণ এই সরকার অন্তর্বর্তী সরকার—নানা ধরনের ফোর্স, নানা ধরনের শক্তি এই সরকারকে গাইড করছে, যার যার ইন্টারেস্টের জায়গা থেকে এটা করছে, এটা বুঝতে হবে।
এসব সমস্যা সমাধানের উপায় জানতে চাইলে সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, সিপিবি বাংলাদেশে এই সমাজ ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চায়। শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন একটা সমাজ গড়তে চায়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটা বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, এইটাকে ধরেই সিপিবি অগ্রসর হচ্ছে। আমরা মনে করি আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। যেভাবে শাসকরা, লুটেরা আধুনিক শ্রেণি দেশটাকে শাসন করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থে একটা গণসংগ্রাম, গণআন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এই সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। এর জন্য বামপন্থি শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, সেই চেষ্টা আমাদের আছে। চেষ্টা আমরা করছি, সময় লাগবে, রাতারাতি সব হয়ে যাবে না। কমিউনিস্ট পার্টি দেশের সব বামপন্থি শক্তির ঐক্য চায়। যারা মুক্তিযুদ্ধকে মানে—এই ধরনের বাম, প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক, পেশাজীবী সংগঠন, দলিত, আদিবাসী, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সুফিবাদে বিশ্বাসী, চা শ্রমিক বা নানা ধরনের শক্তিকে নিয়ে একটা বৃহত্তর বলয় বা একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ফ্রন্ট গড়ে তুলতে চাই। সেই সংগ্রাম এখন আমাদের বাস্তবতা। এর জন্য কমিউনিস্ট পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেসে যে রাজনৈতিক লাইন নেওয়া হয়েছে, সেই লাইন অনুযায়ী আমরা এগোব।
এসকে/এমজেএফ