জুলাই আন্দোলন যখন তু্ঙ্গে তখন শীর্ষ ছাত্র নেতাদের (সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত) বেআইনিভাবে প্রথমে গুম করা এবং পরে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। কিন্তু সংবিধান ও আইন অনুসারে তাদেরকে আদালতে হাজির করা হয়নি।
গত বছরের জুলাই আন্দোলনের নৃশংস ঘটনাগুলোর সঙ্গে এ ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া আনুষ্ঠিক অভিযোগপত্রে। যে মামলায় আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। যদিও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ইতোমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই ফরমাল চার্জ আদালতে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বিক্ষোভ চলাকালে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) এর প্রতিবেদন থেকে উল্লেখ করে এ বিষয়ে বলা হয়, দুটি গোয়েন্দা সংস্থা যৌথভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় নেতাকে আটক ও গ্রেফতার করলেও সংবিধান ও আইন ভঙ্গ করে আদালতে পেশ করেনি। তাদের মধ্যে ছিলেন, নুসরাত তাবাসসুম, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ,আবু বাকের মজুমদার, সারজিস আলম এবং হাসনাত আবদুল্লাহ। আটকের উদ্দেশ্য ছিল তাদের ভয় দেখানো, আন্দোলন দমন করা এবং তাদের চুপ করানো।
১৫ জুলাই থেকেই গোয়েন্দা সংস্থা ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং সরকারকে তাদের দাবি নিয়ে আলোচনার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা করে। ১৮ থেকে ১৯ জুলাই রাতে, প্রথমে তিনজন ছাত্রনেতাকে সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার কথা বলে নিয়ে যায়। পরে, তারা আরও দুইজন ছাত্রনেতাকে তাদের বাসা থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। তাদের গ্রেফতারের কারণ জানানো হয়নি, কোথায় রাখা হবে সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি এবং তাদের আইনজীবীর সঙ্গেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়নি এবং তাদের আদালতে হাজিরও করা হয়নি।
নাহিদ ইসলামকে সম্পর্কে বলা হয়, ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলামকে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা অপহরণ করে বহুল আলোচিত গোপন আটক কেন্দ্র (‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত) আটকে রেখে নির্যাতন করে। পরে তাকে পূর্বাচল এলাকার একটি ব্রিজের নিচে ফেলে দেওয়া হয়। অকথ্য নির্যাতনের কারণে আহত নাহিদ ইসলাম ছাড়া পেয়ে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হলে সেখান থেকে ডিবির সদস্যরা তাকে পুনরায় ২৬ জুলাই তুলে নিয়ে যায়। এ সময় নির্যাতনের কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেকজন ছাত্রনেতাও আটক হন। একজন স্বাস্থ্যকর্মী এতে বাধা দিলে তাকে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেন। ২৭ ও ২৮ জুলাই, আরও চারজন ছাত্রনেতাকে টার্গেট করে অপহরণ করা হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা এই ছয় ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার ও আটক করেছে। তবে সাবেক কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, এই অভিযানগুলো মূলত যারা পরিচালনা করেছিল, তাদের (একটি গোয়েন্দা সংস্থা) গ্রেফতার করার কোনো আইনগত ক্ষমতা নেই। একজন সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখনকার প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন যে, ওই সংস্থার সম্পৃক্ততা নেতিবাচক প্রচারণা তৈরি করতে পারে। তখন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন, ডিবি এই গ্রেফতারগুলো ‘সুরক্ষামূলক হেফাজত’ হিসেবে উপস্থাপন করবে। আটক অবস্থায় ছাত্রনেতাদের ক্যামেরার সামনে একটি বক্তব্য দিতে বাধ্য করা হয়, যেখানে তারা বিক্ষোভ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এই ভিডিও ডিবির প্রধান প্রকাশ করলে জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারপরেও সরকার উক্ত ছয় জনের বেআইনি আটক ও দিনের পর দিন ডিবি আটকে রেখে কোনো তদন্তের নির্দেশ দেয়নি। অন্যদিকে, আইনজীবীরা ছাত্রনেতাদের মুক্তির জন্য আদালতে আবেদন করেন, কিন্তু সরকারের আজ্ঞাবহ আদালত তাদের মুক্তি দেয়নি।
পরবর্তী সময়ে সরকার জনরোষের কারণে ১ আগস্ট ছয় ছাত্রনেতাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
এসব ঘটনাসহ জুলাই আন্দোলনের পুরো ঘটনায় যৌথ দায় হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিবন্ধন (১২৭ নং) করা হয়। ওই অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় আগামী ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য এবং ৪ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
৫ আগস্টের পর ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির।
ইএস