ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ মে ২০২৪, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কী তোমার পরিচয়? || শাহ্ সাজ্জাদ

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
কী তোমার পরিচয়? || শাহ্ সাজ্জাদ

রমজান মাসে বেলা দু’টো থেকে ইফতারির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত লম্বা সময়। অফিস থেকে বাসায় ফিরে, আধঘণ্টার মধ্যে উত্তরায় আমার এক কলিগ সেলিমের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

আমার স্ত্রী নীলিমা ইফতারির আয়োজনে ব্যস্ত, আর ছয় বছরের মেয়ে সুষমা কোনো এক প্রতিবেশীর বাসায়। বউ বলতে পারে। যদিও আশেপাশে আমার মেয়ের বয়সী কোনো বন্ধু-বান্ধবী নেই, তবুও প্রতিবেশীরা তাকে ডেকে নিয়ে যায়। আমার মেয়ে অনেক কথা বলে। হয়তো এটাই একটা কারণ, এ কারণে প্রতিবেশীরা তাকে খুব পছন্দ করে। আমার মেয়ের খোশগল্পে অনেক কিছু ভুলে থাকা যায়। আমি আর নীলিমা বাসায় খুব কম কথা বলি। হয়তো এই শূন্যস্থান পূরণ করার দ্বায়িত্ব নিয়েছে সুষমা। বাসা থেকে বের হওয়ার পথে বউ পাকা পেঁপে আনতে বললো।

পেপে না বাসায় ছিলো?
প্রশ্নটা অবশ্য মনে মনে করেছিলাম। কারণ, আমি যখন কোথাও বের হই তখন দিয়াশলাই থেকে শুরু করে ছোটখাটো নিত্য প্রয়োজনীয় কোনো না কোনো সংসারের সদাই নীলিমা আগাম আনিয়ে রাখে। আমাদের গোছানো সংসার।

সেলিম বাসায় ছিলো না, অগত্যা ভাবির সঙ্গে দু’-একটা কথা বলে বের হয়ে আসি। মলিন মুখে বাসে করে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ করেই মেয়েটিকে চোখে পড়লো। চাকরিজীবীদের ট্রেডমার্ক হটপট, ডায়রি, ফাইলপত্র ইত্যাদির সঙ্গে আরও দু’জন, যারা স্বভাবগতভাবে একটু দৃষ্টি আকর্ষণী আচরণে হৈ-হল্লা করে এয়ারর্পোট বাস স্টপেজ থেকে উঠে ড্রাইভারের আড়াআড়ি বসলো। মেয়েটির চেহারা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, কিন্ত দৃষ্টি বিনিময় হলো না।

মেয়েটিকে দেখে ‘গোবরে পদ্মফুল’ উক্তিটি মাথায় এলো, কিন্তু ঠিক হলো না। কারণ, তার সঙ্গীরাও পদ্মফুল। আবার তাদের মধ্যে সে কোথাও একটু আলাদা। কেন জানি মনে হলো, এই সুশ্রী মেয়েটি হয়তো কঠিন কোনো বাস্তব মোকাবেলা করছে। ভাল করে লক্ষ্য করতে শুরু করলাম। বাস ড্রাইভারের আড়াআড়ি বসায় আমি শুধু মেয়েটির মুখের একপাশ দেখতে পারছি। ভ্রু বেশ টানা টানা, সব মেয়েরা যদি এরকম ভ্রু নিয়ে জন্ম নিনো তাহলে হয়ত ‘ভ্রু-প্লাক’ শব্দটিই সৃষ্টি হতো না। চোখের পাপড়ি ঘন ও প্রসার। সরু নাক ও কিঞ্চিত মোটা ঠোট মিলে তার মুখের এক অপূর্ব সমন্বয়। আচ্ছা, মেয়েটি যখন হাসে তখন কি তার চেহারার বিকৃতি ঘটে? এমনটা হয় ‍অনেকসময়।

কে তুমি? কী তোমার পরিচয়? কল্পনা করতে শুরু করলাম, যে কল্পনা বিয়ের আগেও করতাম। আমার বউ বলে, কলেজ জীবনে আমার মলিন মুখ নাকি তাকে খুব বিচলিত করতো। তার নাকি জানতে ইচ্ছা করতো কি আমার পরিচয়? কেন আমি এতো দুঃখী! আমাদের পরিচয় পর্বের পর নীলিমা যখন জানলো, শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন ঝুটঝামেলা ছাড়া আমার জীবনে তেমন কোনো কালবৈশাখীর ঝড় ওঠেনি, তখন সে নিজের জীবনের গল্প বলতে শুরু করলো। নীলিমার জীবন আমার জীবনের প্রতিফলন মাত্র, তবে এই সুবাদে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হতে লাগলো। আবার এদিকে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে অলৌকিক আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া গেলো যা সচরাচর মফস্বল শহরে বিদ্যমান। আমাদের দুই পরিবারের মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবী নীলিমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে খুব সন্তুষ্ট। বন্ধুরা বলতে লাগলো, ভালো একটা মেয়েকে আমি ভালোবেসেছি।

আমার অস্বীকৃতি, হাসি-ঠাট্টার তলে চাপা পড়লো। আমি নাকি ছোটবেলা থেকে লাজুক প্রকৃতির। ভালোবাসার শেষ অধ্যায় বৈবাহিক জীবনে এসে ‘ভালোবাসা’ কী, এর অর্থ খুঁজে বের করার কোনো প্রয়োজন বোধ করলাম না। মলিন মুখে সংসার করতে থাকলাম। নীলিমার মুখও এখন মলিন। আমরা সুখেই আছি।

জ্যাম হওয়াতে আশেপাশের যাত্রীদের মধ্যে বিরক্তির ঝড় উঠলো। মেয়েটির জগতে আমার উপস্থিতের কিছু একটা সংকেত থাকতে হয়। একবার ভাবলাম, ট্রাফিক জ্যামের উপকারিতা তুলে ধরি। ধরাকে সরা জ্ঞান করা যাকে বলে। কারণ, যেখানে এদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে চাকরি নিশ্চিত করার জন্য ঘুষ বৈধ, সেখানে আমি কাউকে কাছে পাওয়ার জন্য জ্যামকে স্বাগত জানাতে চাচ্ছি।

এদিকে, নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সেলফোন বের করে নাড়াচাড়া করতে থাকলাম। আর মনে-প্রাণে প্রহর গুনছি। এই মুহূর্তে যদি কেউ কল করতো! সেলিমের কল আসার সম্ভাবনা শূন্য। অসীম ধৈর্য্যশীল সেলিম। আগামীকাল অফিসে দেখা হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার মনে কোনো লেশমাত্র চিন্তা-ভাবনা আসবে না। আমাদের যাওয়া-আসা এখন সুবিদিত পর্যায়, হয়তো এটি একটি কারণ। আচ্ছা টেলিপ্যাথি যদি বাস্তব হতো, তাহলে আমার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ যেমন, আমার মামা শ্বশুরকে দিয়ে হলেও কল করানো যেতো।

আমার মামা শ্বশুর সমাজের যোগ্য উত্তরসূরী। ধনে-মানে-গুণে- সবদিক থেকে। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সংসারে তিনি রস খুজে পান না। প্রায়ই তিনি পরিজন সমাবেশ করেন এবং আমার সঙ্গে শালা-দুলাভাইয়ের সর্ম্পকের মতো হাসি-ঠাট্টা করেন। মামা শ্বশুর দাওয়াত দিলে আমাদের বাসায় কিছুটা ঈদের আমেজ আসে। নীলিমা আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের এই সুযোগ সহজে হাত ছাড়া করতে চায় না। এদিকে, আবার আমাকে ছাড়া সে কোথাও যাবেও না। হয়তো এটাই একটা কারণ, আমি কোনোদিন নীলিমাকে এই ব্যাপারে কোননো কটূক্তি করিনি।
 
আচ্ছা, প্রায় সময়ইতো বাস কন্ডাক্টার দুই-তিনবার করে ভাড়া চেয়ে থাকে। এটা ওদের এক ধরনের সিস্টেম বা অভ্যাস, যাতে যেসব যাত্রী ভাড়া না দেওয়ার মতলব আঁটে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন দ্বিতীয়বার ভাড়া চাইলে, লজ্জায় বা বিবেকের তাড়নায় ভাড়া দিয়ে দেয়। এতে কন্ডাক্টারদের লস মিনিমাইজ হয় বা করতে পারে। আমরা যারা সচরাচর ভাড়া দিয়ে থাকি, মোটামুটিভাবে সয়ে নিয়েছি। তবে কিছু চয়েসফুল বকাঝকা স্টকে থাকে যেটা আবার তাদেরও সয়ে গেছে। এটি একটি দুষ্টচক্র, যার সমাধান হয়তো টিকিট সিস্টেমে ছিলো। আজকে যাত্রী সীমিত থাকাতে বাস কন্ডাক্টারকে সিস্টেম চালু করতে হয়নি। বকাঝকা করে মেয়েটির দৃষ্টি আমার দিকে ভেড়ানো যেতো। সামনে অনেক সিট ফাঁকা পড়েছিলো। উঠে গিয়ে সামনে বসবো ভাবতে ভাবতে মেয়েটি হঠাৎ পাশ ফিরে মিষ্টি হাসি দিয়ে তার কলিগদের উদ্দেশ্যে কী যেনো বললো। অপূর্ব! ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হলো- এই যোগসূত্র অবশ্যই উপরের কোনো ইশারা।

মন প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। আমার মন বাসের জানালা দিয়ে গাড়ি-ঘোড়া, দালান-কোঠা ছাড়িয়ে কোনো এক নদীতে গিয়ে থমকে দাড়ালো। আশ্চর্য ব্যপার, আমার ভগ্নমনস্কতার জগতে আমি যেরকম নানান নদীর তীরে বসে নদী উপভোগ করতাম, আজ কেন জানি আমার এই জগৎ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো। দেখলাম, আমি নদীর উপরে পাখির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর নদীর তীরে নীলিমা ও সুষমা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

ট্রাফিক জ্যাম ছাড়লো, বাস ও গাড়ির পাল্লাপালিতে নদী থেকে আমি ফিরে আসি। মহাখালীতে বাস দাঁড়াতে মেয়েটি আর তার সঙ্গীরা উঠে দাঁড়ালো। আমার গন্তব্যও মহাখালী, খুশি হয়ে নামলাম। আরও খুশি হয়ে গেলাম যখন দেখলাম, মেয়েটির কলিগরা দুইজন আলাদা রাস্তা ধরলো। আমিও পিছন পিছন হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ হাতঘড়িতে সময় দেখে নিস্তেজ হয়ে গেলাম।
 
ঘুরে বাজারের দিকে রওয়ানা হই। পরিচিত দোকানদারকে একটা ভালো মিষ্টি পেঁপে দিতে বললাম। আর বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম, পেপে মিষ্টি না হলে কিন্তু তোর ভাবি পেঁপে দিয়ে তরকারি পাকাবে। দোকানদার গদগদ হয়ে হয়ে বললো, স্যার আপনে ভাবিকে খুব ভালবাসেন, তাই না?

আমি নির্বিকারের মতো তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। শেষে আস্তে করে বললাম, গাধা, তোর ভাবি যদি আমাকে সেট মনে না করিয়ে দিতো, তাহলে আজ তোর এই পেপে বেচা হতো না...

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।