ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ২৭)

ধারাবাহিক রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ২৭)

পর্ব ২৬ পড়তে ক্লিক করুন

বল রুম পার্টি ও রক্তঝরা নাচানাচি |
মাদের একটি জনপ্রিয় প্রবাদ আছে। ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’।

কিন্তু বিলাতিরা এই প্রবাদে কতটুকু আস্থা রাখবেন, তা চিন্তার বিষয়! কারণ আক্ষরিক অর্থেই বিলাতিমাত্রই নাচটা তার জানা থাকা চাই, কারণ সময়ে অসময়ে নাচগান করাটা বিলাতি কেতায় একটি সাধারণ ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। “আপনি নাচ জানেন না! তাও কি হয়?” কিন্তু তেমন ঘটনাও বিলাতি সমাজে হতো বৈকি। ১৮৮৯ সালের এক সন্ধ্যা। কলকাতায় বিলাতি মেম মিসেস এসমোরের বাড়িতে ততক্ষণে আড্ডা জমে উঠেছে। ডিনার পার্টিতে গান বাজনা আর সেই সাথে বল নাচের আয়োজন করা হয়েছে। গান করবেন সেই সময়ের নামকরা বিলাতি মেম আদেলা ফ্লোরেন্স ক্লোরি। আদেলা সেই সময়কার বিলাতি সমাজের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। তার গানের সাথে সাথে বেলাড নৃত্য যেন এক স্বর্গীয় বিষয়। এদিকে আগত বিলাতি মেমরা সবাই তাদের সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। ডিনারের পর নাচ গানে অংশগ্রহণ বিলাতিদের সাধারণ ভদ্রতা। আপনি কোনো বাড়িতে গিয়ে ডিনার করবেন অথচ নাচ গানে অংশ নেবেন না, তা হয় না। ডিনার পার্টির নিমন্ত্রণ মানেই সেখানে নাচ গান থাকবে আর থাকবে প্রচুর পানীয়।



প্রেমের পড়ার প্রথম বছরের মাথায়ই আদেলা একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। বইটি সেই সময়ের বিলাতি সমাজে বেশ নাম কুড়িয়েছিল। নাম ‘The Garden of Kama’। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কবিতাগুলো কেন এত জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু সুখের ঠিক পেছনেই দুঃখ নামের শব্দটা ওঁত পেতে থাকে। বিয়ের পনের বছর পর কর্নেল মেলকমের মৃত্যু হয়। কর্নেলের মৃত্যুর পর আদেলার জীবন স্থবির হয়ে যায়। তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন, গান বাজনার ধারে কাছেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতেও কখনো দেখা মেলে নি তার। স্বামীর মৃত্যুতে এতই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, ১৯০৪ সালে আত্মহত্যাই করে বসেন আদেলা



যথারীতি সব বিলাতি সাহেব আর মেমরা জড়ো হলেন বিশাল ড্রয়িং রুম চত্বরে। সবাই যার যার আসনে বসে হালকা পানীয় হাতে নিলেন। ঠিক তখনই পিয়ানোতে মায়াবী আঙুল ছড়িয়ে দিলেন আদেলা ফ্লোরেন্স। তিনি তার বিখ্যাত গান ‘Pale hands I loved beside the Shalimar’ দিয়ে শুরু করলেন। আদেলার গানগুলো সেই সময়ে ‘কাশ্মিরি গান’ হিসেবে বিলাতি আত্মায় বেশ জায়গা করে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে মিসেস এসমোরের ছোট বল রুমটা বেশ জমে ওঠে। সবাই জোড়ায় জোড়ায় কাঁধে হাত রেখে নাচে অংশ নেন। কিন্তু একটি চেয়ারে লাল গেলাস হাতে মাতাল হয়ে বসে রইলেন এক লালমুখো বিলাতি সাহেব। গানের সঙ্গে মিলিয়ে পায়ে তাল ঠুকছেন ঠিকই কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে বল রুমে যাওয়ার শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটিই তার নেই। গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কালো কাঁচা গোঁফ। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ তো হবেই।   মাথার ধূসর টুপিটা মাতাল অবস্থায়ও খুব বাধ্য হয়ে ঠিক জায়গায় বসে আছে। জানা গেল মদ খেয়ে চুর হওয়া বিলাতি সাহেবটির নাম মেলকম নিকলসন। বিলাতি সামরিক বাহিনীর একজন কর্নেল তিনি। মেজাজ মর্জি নাকি কখনোই ভালো থাকে না। অসামাজিক মানুষ হিসেবে ইতোমধ্যেই সমাজে বেশ দুর্নাম কুড়িয়েছেন।

বল রুমে সবাই তখন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু গান গাইতে পারার পাশাপাশি আদেলা যেহেতু একজন কবিও, তার চোখ ঠিকই আটকে গেল জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা কর্নেলটির দিকে। বলা নেই কওয়া নেই আদেলা হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসলেন। গাইতে গাইতে তিনি কর্নেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মোহনীয় হাসি ফুটিয়ে হাত দুটি বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে। “আমি গান গাইছি অথচ আপনি নাচবেন না, তা কি হয়?” কর্নেল মেলকম নিকলসন কায়দা করে টুপিটা খুলে আদেলাকে অভিবাদন জানালেন। কিন্তু তারপর আবারও বন্ধ করে ফেললেন চোখ। প্রচণ্ডরকম অপমানজনক একটা ঘটনা। কিন্তু আদেলা মন খারাপ করলেন না। আদেলার চোখে তখন অন্যরকম এক নেশা। যেখানে বিলাতি পুরুষমাত্রই তাকে দেখলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সেখানে সামান্য এই কর্নেলটির অবজ্ঞা আদেলাকে তার প্রতি আরো বেশি মনোযোগী করে তুলল। মাঝরাত পর্যন্ত অনেক নাচ গান হলো। একে একে সব অতিথিরাও বিদায় নিলেন। কর্নেল মেলকম নিকলসনও উঠলেন। ধীরে ধীরে দরজা পর্যন্ত এসে কী মনে করে আবার দাঁড়ালেন। ঘাড়টা বাঁকিয়ে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে আদেলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “অসম্ভব সুন্দর একটা গানের রাত উপহার দেওয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আমার বেশ ভালো লাগছে। শুভরাত্রি। ”

বদ মেজাজি কর্নেলের মুখে এমন মায়াবী উচ্চারণে উপস্থিত অনেকেই মুচকি হাসলেন। কিন্তু গম্ভীর হয়ে রইলেন আদেলা ফ্লোরেন্স। বোঝা যায়, মনের গহীন কোণে অন্যরকম কোনো কাটাকাটি হচ্ছে তার। সেই থেকে শুরু। আদেলা আর মেলকম ভালোবাসার জুটি বাঁধলেন। তারপর মহা ধুমধামে বিয়ে। আদেলার ভাষায়, “আহা! মেলকমের মতো এমন সুরসিক একজন প্রেমিকের দেখা আরো আগে কেন পেলাম না?” প্রেমের পড়ার প্রথম বছরের মাথায়ই আদেলা একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। বইটি সেই সময়ের বিলাতি সমাজে বেশ নাম কুড়িয়েছিল। নাম ‘The Garden of Kama’। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কবিতাগুলো কেন এত জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু সুখের ঠিক পেছনেই দুঃখ নামের শব্দটা ওঁত পেতে থাকে। বিয়ের পনের বছর পর কর্নেল মেলকমের মৃত্যু হয়। কর্নেলের মৃত্যুর পর আদেলার জীবন স্থবির হয়ে যায়। তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন, গান বাজনার ধারে কাছেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতেও কখনো দেখা মেলে নি তার। স্বামীর মৃত্যুতে এতই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, ১৯০৪ সালে আত্মহত্যাই করে বসেন আদেলা।

চলুন আরেকবার বিলাতি নারীদের বল রুমে ঢুঁ মেরে আসি। ১৮৪০ সালে বিলাতি মেম জুলিয়া কার্টিস এক রোজনামচায় লিখছেন, “ছোট্ট একটা পিয়ানোকে কেন্দ্র করে সবাই সারিবদ্ধ হয়ে গানের তালে তালে শরীর দুলাচ্ছিলাম। প্রথম গানটি ছিল ‘লাভস গোল্ডেন ড্রিম’ এবং তার পরপরই ‘এল ডোরাডো’। আহা! কী সুখকর অনুভতি!” আঠার শতকে বিলাতি নারীরা বিভিন্ন ধরনের নাচে পটু ছিলেন। ১৮৮০ সালে The Pioneer পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের দিকে চোখ রাখা যাক। প্রতিবেদনে তৎকালীন বিলাতি নারীদের পছন্দের নাচগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ হয়েছিল। জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানীয় নাচগুলো ছিল: Reels, Mazrukas,Waltzes, Polkas Ges Gallops.

আঠার শতকে কলকাতায় লর্ড কার্জনের দেওয়া ‘ডিনার পার্টি’ বেশ জনপ্রিয় হয়। “শুধুই কি ডিনার পার্টি? সেখানে নাচ গানের জন্যে হাজার দুয়েক বিলাতি নর এবং নারী জড়ো হয়েছিলেন। ” (ওমেন অব দ্য রাজ: দ্য মাদার্স, ডটার্স, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটার্স অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া। লেখক মার্গারেট মেকমিলান, রেনডম হাউস ট্রেড, ২০০৫) জানা যায় এসব ডিনার পার্টি নিছক বিনোদনের জন্যই আয়োজিত হতো না। বল রুমে নাচের তালে তালে ভারতবর্ষের অনেক জটিল সমস্যা সমাধানের পথও খোঁজা হতো।

ঊনিশ শতকের শুরুর দিক থেকেই কলকাতায় বিভিন্ন বনেদি রেস্তোরাঁ এবং ক্লাবে নাচের আয়োজন হতো। পার্টিতে এলাকার গণ্যমান্য ও সৌখিন বিলাতি নারীদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। সাধারণত সপ্তাহের শনিবার এই পার্টির আয়োজন করত বিলাতিরা। পার্টিতে যে নাচ হতো তার নাম ‘টি ডেনসেস’।

একই সময়ে ভারতে সৌখিন নামি দামি জামা পরে ‘ড্রেস বল’ নৃত্য বেশ জনপ্রিয়তা পায়। যাযাবর অথবা আরব ডাকাতদের পোশাকে ছদ্মবেশ নিয়ে বিলাতি মেমরা ড্রেস বল করতে ভালোবাসতেন। বিত্তশালী বিলাতি মেমরা তাদের মনের মতো নাচের পোশাক লন্ডন থেকে তৈরি করে আনাতেন। ১৮৮০ সালে মাদ্রাজের গভর্নর গ্রেন্ট ডাফ এবং তার স্ত্রী হিরা জহরত খচিত জামা পরে বল রুমে নাচের আসর বসিয়েছিলেন। উচ্চমূল্যের এই পোশাক পরে বল রুমে জুটি হয়ে নাচার মজাই হয়ত আলাদা! তা না হলে লর্ড কার্জন পর্যন্ত একশ’ বছর আগের বিলাতি হিরো রিচার্ড ওয়েসলের ছদ্মবেশ নিয়ে বলরুমে নাচতে নামবেন কেন? আসলে জাতীয় বীরদের জামা কাপড়ের অনুকরণে দামি নকল জামা তৈরি করে বলরুমে নাচাটা ছিল সেই সময়ে বিলাতি সমাজের অন্যতম একটি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। কার্জনই বা তার থেকে দূরে থাকবেন কেন?

১৮৬০ সালে রাওয়ালপিন্ডি থেকে বিলাতি মেম মিনি ব্লান এক চিঠিতে তার মাকে জানাচ্ছেন : “চতুর্থ পাঞ্জাব সেনাকুঞ্জের সৌজন্যে নতুন বছর উপলক্ষে ৩১ ডিসেম্বর রাতে বল রুমে নাচের পার্টিটা ছিল এক কথায় চমৎকার। কী সুন্দর সেই মুহূর্ত! আমি এবং আরো দুজন বিলাতি নারী মিলে প্রাণ খুলে ‘Waltzes’ আর Polkas নেচেছিলাম। পার্টিতে আমরা ছাড়াও আরো দশজন নারী এবং ত্রিশজন পুরুষ ছিলেন। উপস্থিত সবাই তাদের জানা সব রকম নাচই নাচতে চাইলেন। আমি আমার জানা ঊনিশ রকম নাচ নেচেছিলাম। একসময় নাচতে নাচতে জুতোর আঘাতে পায়ের চামড়া ছিলে রক্ত বের হয়ে গেল। তারপর ঘরে ফিরলাম। ”

পর্ব ২৮ পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।