___________________________________
এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
___________________________________
৩৮তম কিস্তির লিংক
আশপাশটা হেঁটে দেখার জন্য চায়ের টেবিল থেকে আমরা উঠেছি, তখন দেখলাম মারিয়া আমাদের দিকে আসছে, যা আমার ধারণাকে পুরো নিশ্চিত প্রমাণ করল: অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে টেবিলের ওই উদ্ভট আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে মারিয়া।
এরপর যতবার আমরা অন্যলোকের সঙ্গে থেকেছি এবং ও আমার কাছে এসেছে, আমি ভেবেছি, ‘এই বিস্ময়কর নারী আর আমার মধ্যে গোপন এক সেতুবন্ধ তৈরি হয়েছে। ’ পরে, আমি যখন আমার এই অনুভূতি পর্যালোচনা করে দেখেছি, আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে ও আমার জন্য অপরিহার্য (অনেকটা জনমানবহীন কোনো দ্বীপে কাউকে খুঁজে পাওয়ার মতো) এবং পরবর্তী সময়— নিঃসঙ্গতার ভয়টা এক সময় পুরোপুরি কেটে যাওয়া পরও হল আমার এক প্রকার বিলাসিতা যার জন্য আমি দারুণরকম গর্ববোধ করেছি। এটা আমার প্রেমের দ্বিতীয় পর্যায়ের সময়কার ঘটনা, যে সময়ে গুচ্ছের সব ঝামেলা দেখা দিতে শুরু করেছে। আমার তখন ক্ষুধায় প্রায় মারা যাওয়ার মতো অবস্থা। সামনে তখন যা জুটবে তাই খাওয়ার জন্যই তৈরি, কিন্তু পরে, এক সময় জরুরি প্রয়োজন যখন মিটে গেল, আস্তে আস্তে নানা সমস্যা-অভিযোগ মাথা তুলতে শুরু করল। এদেশে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে আসা জীর্ণশীর্ণ চেহারার রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আমি দেখেছি, তারা দু’পয়সা মিলবে এরকম যে কোনা চাকুরি সানন্দে গ্রহণ করেছে, সেটা অনেক ছোট কাজটা হলেও। কিন্তু এটা কি বিস্ময়কর না যে নির্যাতন আর মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসার পরও একজন মানুষ কেন পরিতৃপ্ত থাকতে পারবে না? যেই সে তার নতুন নিরাপত্তা উপভোগ করতে শুরু করল, অমনি তার অহঙ্কার আর দর্প আর ঔদ্বত্য যা চিরতরে নিশ্চিহ্ন্ হয়ে গিয়েছিল বলে ধরা হয়েছিল তা আবার হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে আসতে শুরু করল, যেন তাড়িয়ে আনা কোনো পশুরদল— তবে নিজেদেরকে এভাবে উপস্থাপনের সময় সঙ্গে এই প্রকটরকম ঔদ্ধত্য প্রকাশ যেন অতীতের অসম্মানজনিত লজ্জারই পাল্টা জবাব। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অকৃতজ্ঞতা আর পর্যাপ্ত স্বীকৃতি না দেওয়া ঘটনার একেবারে দুলর্ভ না।
এখন এই শান্ত পরিবেশে এসে আমার আবেগের সঠিক বিচার-বিশ্লেষণের একটা সুযোগ এসেছে, আমি মনে করি মারিয়ার সঙ্গে আমার সর্ম্পকে ওরকম কিছু একটা ছিল, আর এটা আমি এখন অনুভব করি আমার ওই পাগলামী দেখে মারিয়া যে সময় আমাকে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি (সাময়িকভাবে) এনে দিয়েছিল আমি শুধু তাই নিয়ে খুশি থাকিনি।
বাধভাঙা অহঙ্কারের ঢেউ, আমার মধ্যে ওর একচ্ছত্র মালিক হওয়ার বাসনাকে যেভাবে তীব্রতর করে তুলছিল, যে ভাবে আমি আত্মশ্লাগা আর ঔদ্ধত্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিলাম— আমাকে সর্তক করা উচিত ছিল যে আমি ভুল পথে যাচ্ছি।
এই বিকেলে মারিয়াকে যখন আমার দিকে হেঁটে আসতে দেখছি, আমার ভেতরের সব দর্পকে একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে গুড়িয়ে দিচ্ছিল ওই দিনের স্টুডিওর কুৎসিত সেই দৃশ্য থেকে উঠে আসা লজ্জা, অপরাধবোধ, আর ওর বিরুদ্ধে তোলা আমার ‘কানা লোককে ঠকানো’র অতি নির্বোধ, নিষ্ঠুর এমন কী অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণভাবে তোলা অভিযোগটা।
আমি টের পাচ্ছি আমার হাঁটুর জোর কমে আসছে, আমার মুখমণ্ডল বিবর্ণ, আর বরফের মতো শীতল হয়ে গেছে। ওর পায়ের ওপর এখন আমাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে হবে, ওকে বলতে হবে আমাকে তুমি পরিশুদ্ধ করো আমার নিজের ওপর জমা ওঠে সব বিরাগ আর ঘৃণা থেকে তুমি আমাকে মুক্ত করো!
বিপরীতে, মারিয়াকে দেখে মনে হলো নিজের মধ্যে পুরো আত্মমগ্ন হয়ে আছে সে; প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার অস্পষ্ট বিষন্নতা ফিরে আসতে শুরু করল।
(চলবে)
৪০তম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৪