ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ মে ২০২৪, ০১ জিলকদ ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নজরুল-চেতনায় বসন্ত ।। মজিদ মাহমুদ

শিল্প-সাহিত্য / প্রবন্ধ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৪
নজরুল-চেতনায় বসন্ত ।। মজিদ মাহমুদ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

(‘নজরুল চেতনায় বসন্ত’ শিরোনামের এই প্রবন্ধটি গতকাল পহেলা ফাল্গুন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাহিত্য সংগঠন অধিকোষের আয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেমিনার কক্ষে পাঠ করেন কবি ও গবেষক মজিদ মাহমুদ। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও রবীন্দ্র-গবেষক ড. আতিউর রহমান, কবি নাসির আহমেদ, শিশু সাহিত্যিক মাহফুজুর রহমান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তাগণ।

বাঙালির বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য প্রবন্ধটি উন্মুক্ত করা হলো। )

নজরুল সাহিত্যে ‘বসন্ত’ প্রতিপন্ন করা আপাত বিরুদ্ধার্থক মনে হলেও বিদ্রোহী ও বিপ্লবী কবির মৌল-প্রবণতার সঙ্গে এই চেতনার বৈপরীত্য নেই। শুরুতেই আমি ‘বসন্ত’কে একটি চেতনা কিংবা অধিকন্তু একটি ধারণা হিসাবে উল্লেখ করতে চাই। কারণ বাংলা সাহিত্যে যেমন বসন্ত এক-রৈখিক ব্যবহারে সীমাবদ্ধ নয়, তেমনি পৃথিবীর সকল প্রান্তের বসন্তের শ্রী,  হ্রী ও সময়-চেতনা এক রকম নয়। আমরা জানি একটি রোগের নাম বসন্ত, ইংরেজিতে যাকে পক্স বা চিকেন পক্স বলে; অথচ আজ থেকে প্রায় কমবেশি তিন দশক পিছনে গেলে এ দেশে প্রায়-প্রায়ই এই রোগের প্রকোপ দেখা দিতো, মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ত, এমনকি কখনো কখনো এতে জনপদ উজাড় হওয়ার আশঙ্কা পর্যন্ত দেখা যেতো। এখনো অবশ্য চিকেন পক্সের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। এই রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য আমাদের মধ্যযুগের কবিরা এক ধরনের কাহিনী-কাব্য রচনা করতেন— যার নাম ছিল ‘শীতলা-মঙ্গল’। আমাদের জানা আছে, বসন্ত নামের এই রোগটি যে দেবি নিয়ন্ত্রণ করতেন তার নাম ‘শীতলা’— এ এক অ্যাম্বিগুইটি বা দ্বিরুক্তিবদাভাষ; যে দেবির রয়েছে এমন অনিষ্ট করবার ক্ষমতা, যে রোগে শরীর যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়, চামড়া গলে পড়ে— সেই নিঠুরা দেবির নাম শীতলা! এর মধ্য দিয়ে অবশ্য বাঙালি চরিত্রের অসহায়ত্ব ও দ্বিধাগ্রস্ততার প্রমাণ মেলে। তবে একটি কারণে এই রোগটির নামের সার্থকতা আছে তাহলো এর প্রকোপ মূলত বসন্তকালে দেখা যায়। এ স্থলে আমি নজরুল-জীবনে প্রাসঙ্গিক আরো একটি মর্মান্তিক তথ্য পরিবেশনে বিরত থাকছি— যা সময় মতো উল্লেখ করব।

মূল রচনায় যাওয়ার আগে আমি বিষয়টি একটু খোলাসা করে নিতে চাই, তাহলো নজরুল-কাব্যে আমরা যে বসন্ত দেখব বা দেখতে চাই তার স্বরূপ কেমন। কারণ বসন্ত একটি কালিক ধারণা ও বছরের ঋতুগত পরিবর্তন ছাড়া কিছু নয়। এই ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে কবি-মনের এমন কী সম্পর্ক রয়েছে, যা আমাদের অবিভূত ও আপ্লুত করে। চরম সত্য এই যে, মানুষ প্রকৃতির সন্তান; প্রকৃতির রূপ ও মেজাজ পবির্তনের সঙ্গে তার সংগ্রাম ও টিকে থাকা। মানুষ প্রকৃতির ওপরে যেমন নিজের জয়ধ্বজা উড়িয়েছে, প্রকৃতিও তাকে দিয়েছে আনন্দের সকল উপকরণ। মানুষ পৃথিবীর রূপ-বৈচিত্র্য, আবহাওয়াগত আরাম-আয়েস বিবেচনায় এক অমিয় স্বর্গের ধারণা তৈরি করেছে; আর সূর্যের আহ্নিক গতির ফলে বছরের একটি সময় পৃথিবীর প্রাণিকূলের জন্য নেমে আসে যৌবন। মানুষ সকল জরা ও জীর্ণতাকে উপেক্ষা করে নব-উদ্যমে জীবনকে সাজিয়ে তুলতে চায়।   প্রকৃতি মেতে ওঠে জন্ম-দানের নতুন উৎসবে। শীতে যারা ছিল জীর্ণ, হাইবারনেশনে— বসন্তের আগমনে সেই রূপ পাল্টে যায় মুহূর্তে। পৃথিবী নতুন রূপে জেগে ওঠে, প্রকৃতিতে প্রাণ ফিরে আসে; শীতের নীরব পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে কুঞ্জবন; বৃক্ষের শুষ্ক শাখার পল্লব কন্দরে চোখ মেলে সুগন্ধি ফুলের বাহার; মধুলোভী মৌমাছিরা মকরন্দের খোঁজে ফুলের চারপাশে গুঞ্জরণ করে; এরই ফাঁকে তারা ঘটিয়ে দেয় পুষ্পে-পুষ্পে বিবাহ, স্ত্রী ও পুরুষ ফুলের মিলন। এই সব মনোরম দৃশ্য আমাদের দৃষ্টিকে পরিতৃপ্তি দান করে। রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে ইচ্ছে করে, ‘ফুলের বনে যার পাশে যাই/ তারেই লাগে ভালো। ’ কেবল মানুষ নয়, জগতের প্রাণিকুল মেতে ওঠে স্বাধীন সত্তায়; তাই ইংরেজ কবি টি.এস এলিয়ট এপ্রিলকে সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস বলে অভিহিত করেছেন; কারণ ইংরেজের বসন্ত আসে এপ্রিলে— এ মাসে কেউ কাউকে ছাড় দেয় না; সকলেই নিজের আনন্দে বিভাজিত হতে থাকে। উইলয়ম ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার প্রাক-বসন্তে লেখা কবিতায় বলছেন, ‘বসন্ত আসে স্বয়ং স্বর্গ থেকে, প্রকৃতি পবিত্রতায় পুষ্পিত হয়— অতএব, এখন শোক করবার সময় নয়। ’ একই ভাবে রবার্ট ফ্রস্ট তার ‘এ প্রেইয়ার ইন স্প্রিং’ কবিতায় বসন্তের কাছে প্রার্থনা করেছেন— ‘তুমি আমাদের পুষ্পের আনন্দ দাও, তুমি আমাদের ভালোবাসা দাও, ভালোবাসার চেয়ে ভালো কিছুই হয় না। ’ কেবল ইংরেজ কবি নয়, আদি বাঙালি কবিদেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি এই সুন্দরতম ঋতুর সম্ভার। যদিও বাঙালির বসন্ত ইংরেজের মতো তীব্র নয়; কারণ শীতের প্রকোপ যেখানে যত তীব্র, বসন্তের আকাঙ্ক্ষা সেখানে তত গভীর। তবু মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো তার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে প্রাক-বসন্তের বর্ণনা দিচ্ছেন এই ভাবে—  ‘মন্দ মন্দ বহে শীত দক্ষিণ পবন। / অশোক কিংশুক রামা করে আলিঙ্গন॥ / কেতকী ধাতকী / ফোটে চম্পকবরণ। / কুসুম পরাগে শ্লথ হৈল অলিগণ॥’ এখানে মধ্যযুগের আরেকজন শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তার অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলছেন— ‘কল কোকিল অলিকুল বকুল ফুলে। / বসিলা অন্নপূর্ণা মণি-দেউলে॥ / বসন্ত রাজা আনি ছয় রাগিণী বাণী। / পাতিল রাজধানী অশোকমূলে॥’ তবে এই কবিতায় বসন্ত বর্ণনা থাকলেও কবি ‘বসন্ত’ শব্দটির একটি এ্যাম্বিগুইটি তৈরি করেছেন। অর্থাৎ বসন্ত এখানে শুধু ঋতু নয়, বসন্ত এখানে রাজা বসন্ত রায়ও বটে। মধ্যযুগের এই কবি শ্লেষ ও দ্বিরুক্তি তৈরি এবং আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারে ছিলেন উস্তাদ।

এই আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে, যে বসন্তের উপস্থিতি একটি কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ, নজরুল সাহিত্যের সেই বসন্ত আলোচনা আমাদের একমাত্র উদ্দীষ্ট নয়। নজরুল-মানসের মধ্যে একটি চেতনার বসন্ত সদা-জাগরুক ছিল— যেটি তার রোম্যান্টিক কবি-মানসের ফল। অর্থাৎ আমরা যে নজরুলকে চিনি, সে নজরুল একজন স্বঘোষিত আইন না-মানা আউটলয়েড দুর্দম কবি। যিনি বিদ্রোহী, কামাল পাশা, রক্তাম্বর ধারিনী মা, আনন্দময়ীর আগমনীর মতো কবিতা রচনা করে ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন; ব্রিটিশ শাসনের কোপানলে কারবরণ করেছিলেন, কারাভ্যন্তরে কয়েদিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অনিয়মের প্রতিবাদে ঊনচল্লিশ দিন অনশন পালন করে নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন; আবার কবি জীবনের শুরুতে পল্টনে যোগদান করে বাঙালির যুদ্ধে না যাওয়ার অভিযোগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এই প্রতিবাদি চেতনার মূলে ছিল, তার সহজাত স্বাধীনতার বোধ; যখনই তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যখনই প্রেম ভালোবাসার বিরুদ্ধবাদিতা প্রবল হয়ে উঠেছে; তখনই তিনি অনাচার বৈষম্য ও কূপম-কতার বিরুদ্ধে খড়্গ-হস্ত হয়েছেন। নজরুল এই জন্যই লড়াই করেছেন যে, সকল অনাচার হটিয়ে দিয়ে একটি স্বাধীন ও বসন্তময় দেশ চেতনার বিকাশ ঘটবে। সকল বিপ্লবের মূল কথাও অবশ্য তা-ই, স্বয়ং মার্কসীয় ধারণার সফল রাষ্ট্র একটি রাষ্ট্রহীনতায় উন্নীত হতে চায়, যেখানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, দমন ও নির্যাতনের বাইরে স্বাধীন একটি নৈরাজ্যিক পৃথিবীর অভিযাত্রা হবে। যদিও তা বাস্তবে একটি ইউটোপিয়া, তবু কবি হিসাবে নজরুলের মধ্যে সেই অ্যানার্কিজমের ইঙ্গিত আমরা লক্ষ করি— তার জীবন বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতায়। শৈশবেই লেটো দলের কনিষ্টতম সদস্য হিসাবে বসন্তের পাখির মতো গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দানের মাধ্যমেই তার কবি জীবনের সূচনা। পরপালিত কোকিলের মতো সারাজীবন তিনি এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে ছুটে বেরিয়েছেন। তিনি যখন যার তখন তার, সব গৃহে ছিল তার ঠাঁই। বুদ্ধদেব বসু নজরুলের এই অবস্থাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভারতীয় দর্শন চেতনার সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের প্রেম-লীলার সঙ্গে আমাদের ধারণাগত বসন্তের মিল রয়েছে। হোলি ও রাসলীলার মতো সনাতন ধর্মীয় উৎসব— নজরুলের অসংখ্য গান ও বৈষ্ণব-পদালীতে সুরের আনন্দে ধরা পড়েছে। তবে আমার মনে হয়, নজরুলের চেতনাগত বসন্তের আবিষ্কারক এবং স্বীকৃতিদাতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি নজরুলকে ‘জাতির জীবনে বসন্ত’ বলে অভিহিত করেছেন। সুতরাং ‘বসন্ত’-এর শাব্দিক কোনোটেশন নিয়ে আমাদের বহুমুখী বিশ্লেষণের চূড়ান্ত মাত্রা রবীন্দ্রনাথের দান। কবি হিসাবে নজরুল ছিলেন বসন্তের কন্টিবিউটর, আর রবীন্দ্রনাথ বলছেন, নজরুল নিজেই বসন্ত; যে-সে বসন্ত নয়, জাতির জীবনে বসন্ত। তার অবির্ভাবে পরাধীন জাতির মধ্যে স্বাধীনতার মৃদু-অবাধ সমীরণ বয়ে গেছে। মাত্র তেইশ বছর বয়সে নজরুল ইসলাম যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি, তখন কবিগুরু তাকে তার গীতিপালা ‘বসন্ত’ নাটকটি উৎসর্গ করেন। এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, আজকের দিনের জন্যও নয়—  একজন নোবেল লোরিয়েট যিনি একজন তরুণ কবি যে কিনা দুর্মুখদের কথায়— অসির ঝনঝনানি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্নিগ্ধ স্বরকে বাঁধাগ্রস্ত করছেন, আর তাকেই কিনা তিনি বই উৎসর্গ করছেন, বলছেন, ‘জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈ কি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও এই সুর বাজত। ’ বইটি রবীন্দ্রনাথ নজরুল-বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে জেলগেটে নজরুলের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপধ্যায় তার লেখায় বলেছেন, কবিগুরু বলতেন, ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম। ’ বইটি হাতে পেয়ে পবিত্রকে জড়িয়ে ধরে নজরুল নাচতে শুরু করেন। বইখানা বুকে চেপে ধরেন। রবীন্দ্রনাথ বসন্তের সিম্বল হিসাবে নজরুলকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, নজরুল তার নিজের জীবনকেও দেদীপ্যমান বসন্তের রঙে সাজিয়ে নিয়েছিলেন; বাসন্তী রঙ ছিল তার সর্বাধিক প্রিয়; বলতেন অনেক লোকের মাঝ থেকেও তাকে যেন চট করে চিনে নেয়া যায়।

এবার নজরুল কাব্যে ও গানে বসন্তের ব্যবহার নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা যাক। বিশেষত তার কবিতা ও গানে সরাসরি বসন্তের উপস্থিতি আমরা ব্যাপকভাবে টের পাই। এমনকি তিনি ‘বাসন্তিকা’ নামে একটি একাঙ্ক নাটক রচনা করেছিলেন। যেখানে কুশীলব হিসাবে আছেন হৃদয় রাজ্যের রাজা স্বয়ং ফাল্গুনী। নজরুল তার এই নাটকে দখিন হাওয়াকে বানিয়েছেন হৃদয়রাজ ফাল্গনীর মন্ত্রী, কোকিল ঐ রাজার দূত, পঞ্চশর ঐ রাজার সেনাপতি; এ ছাড়াও চরিত্র হিসাবে আছে ভ্রমর, মৌমাছি, প্রজাপতি, দোয়েল শ্যামা। নারী চরিত্র হিসাবে তিনি এনেছেন, বাসন্তিকা— যিনি ফুলের দেশের রাণী আর চৈতালী রানীর প্রিয় সহচরী। এই একাঙ্ক নাটকটির মূলভাব বিরহ, যেটি নজরুল কাব্য ও প্রেমের মর্মবেদনা। রবীন্দ্র-কাব্যে আমরা যতটা পাবার আকুতি, মিলিত হবার প্রকাশ দেখতে পাই; অধিকাংশ ক্ষেত্রে নজরুলে তার বিপরীত। নজরুলকে সর্বদা পেয়ে হারাবার ভয়ে বসন্তের মতো ক্ষণকালীণ আশঙ্কায় আক্রান্ত করে রাখে। তাই তিনি বলেন, ‘যদি তোমায় পেয়ে হারাই/ দূরে দূরে থাকি গো তাই। ’ নজরুল নিজেকে সর্বদা ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের সাথে তুলনা করতেন; তাদের বেশিরভাগেরই অকালে প্রয়াণ হয়েছিল; তাদের জীবনের অতৃপ্ত প্রেম নজরুলকে সর্বদা তাড়িত করে বেড়াত। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের তুখোড় ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে প্রেমে পড়ার পর এই অনুভূতির তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। তিনি তার বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লিখিত এক পত্রে বলেন, ‘আমার রক্তে শেলীকে কীটসকে এত করে অনুভব করছি কেন? বলতে পার? কীটসের প্রিয়া ফ্যানিকে লেখা তার কবিতা পড়ে মনে হচ্ছে, যেন এ কবিতা আমিই লিখে গেছি। কীটসের সোরথ্রোট হয়েছিল— আর তাতেই মরলও শেষে— ... কণ্ঠপ্রদাহ রোগে আমিও ভুগছি ঢাকা থেকে এসে অবধি রক্তও উঠছে মাঝে মাঝে— আর মনে হচ্ছে আমি যেন কীটস। সে কোন্ ফ্যানির নিষ্করুণ নির্মমতায় হয়ত বা আমারও বুকের চাপ ধরা রক্ত তেমনি করে কোন্দিন শেষ ঝলক উঠে আমায় বিয়ের বরের মতো করে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে। ’ (নজরুল রচনাবলী, চতুর্থখ-, বা/এ, ১৯৯৩, পৃ: ৪০৯)।

ফলে নজরুল আনন্দময় বসন্ত নিয়ে গান-কবিতা রচনা করলেও বিরহের সে সুর ভুলতে পারেননি। বাসন্তিকা নাটকেও ফুলের দেশের রানী বাসন্তিকা হৃদয় রাজ্যের রাজা ফাল্গুনীকে ধরে রাখতে চায়; বলে, ‘যেতে নাহি দিব আমি। তুমি রাজা, বীর, / আমারে বধিয়া যাও তব রাজ্যে ফিরে। ’ কিন্তু ফাল্গুনী তার জবাবে বলে, ‘তবু মোর যেতে হবে! ছিঁড়িবে হৃদয়/ করিতে হইবে ছিন্ন এই ডোর। / ভালোবেসে কাঁদি আমি কাঁদিয়া কাঁদাই/ এ মোর আত্মার ধর্ম! হে প্রিয়া বিদায়!’— এই হলো মূলত নজরুলের বসন্তের ধরন। নজরুল-জীবনে একই সঙ্গে প্রেমে ও বিরহে, আনন্দ ও বেদনায় বসন্তের উপস্থিতি। ১৯২৬ সালের দিকে নজরুল কবিতা থেকে অনেকটা গানের দিকে ঝুকে পড়েছিলেন; আর এই গানের কথা ও সুরে কবির জীবনের বসন্ত উছলিয়ে উঠছিল। এই সময়ে জন্ম নেয় তার স্নেহের ধন বুলবুল; বুলবুল ছিল কবির প্রিয় পাখি, পারস্যের মরমী কবি হাফিজেরও প্রিয় পাখি ছিল বুলবুল। বুলবুলকে মূলত তারা গান ও আনন্দের সিম্বল হিসাবে তৈরি করেছিলেন; যে আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে যোগসাজশের দূতালি করতে পারে। হাফিজের গজলের সঙ্গে কবির যদিও পরিচয় শৈশব থেকেই; রবীন্দ্রনাথের মতো পারিবারিক আবহের মধ্যেই তিনি হাফিজের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন; তবে পল্টন জীবনে একজন ফারসি জানা পণ্ডিতের কাছে নজরুল হাফিজের কবিতা রপ্ত করেছিলেন বলে জানা যায়; বাকি জীবন এই গানের বুলবুলি থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি। আপন সন্তানের নাম রাখলেন বুলবুল; কিন্তু মাত্র চার বছরের মাথায় শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল সেই গানের বুলবুলি। নজরুল-জীবনে নেমে এলা এক মর্মন্তুদ সময়। প্রাণঘাতি সেই অনুক্ত ঘাতক ‘বসন্ত’ কবির প্রাণপ্রিয় বুলবুলিকে বধ করে গেল। সুতরাং বসন্তের আনন্দ ও বেদনা থেকে কবি বাকি জীবনে আর মুক্ত হতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথকেও অনেক মৃত্যু সইতে হয়েছিল, অকালে পুত্র ও কন্যাদের চলে যাওয়া, প্রিয়জনের বিদায় তাকে ব্যথিত করেছিল; কিন্তু এইসব মর্মান্তিক মানবীয় ব্যথা সহ্য করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মহাস্থবির, নীলকণ্ঠ; গান ও কবিতায় গেঁথে দিয়েছিলেন সেই সব অনিবার্য পরিণতির মানবীয় বাণী।

কবির বসন্ত প্রকাশের অন্যতম রীতি ছিল বুলবুল। ১৯২৮ সালে ৪২টি গান নিয়ে ‘বুলবুল’ নামে তার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার একটি গজলের শিরোনাম— ‘আসে বসন্ত ফুলবনে। ’ এটি ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে পৌষের সওগাতে ছাপা হয়। যার দুএকটি চরণ ‘আসে বসন্ত ফুলবনে/ সাজে বনভূমি সুন্দরী/ চরণে পায়েলা রুমুঝুমু/ মধুপ উঠেছে গুঞ্জরি॥’ এর পর থেকে দেখা যাচ্ছে নজরুল প্রায় বসন্তের বুলবুল নিয়ে গান-কাব্য রচনা করছেন। তবে এর আগে কবির বসন্ত নিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা হলো ‘চৈতী হাওয়া’— এটি রচিত হয় ১৩৩১ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। সেখানেও তিনি বুলবুলিকে ভুলতে পারেননি। যেমন— ‘চৈতী রাতের গাইত গজল বুলবুলিয়ার বর, / দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর! / ভূঁই-তারকা সুন্দরী / সজনে ফুলের দল ঝরি / থোপা থোপা লাজ ছড়াত দোলন-খোপার ’পর, / ঝাঁজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙ্গার স্বর!’

কিন্তু দুর্ভাগ্য! বসন্তের কবিতা হিসাবে এটি মিলনাত্মক হলেও বিষয় হিসাবে দিব্যি মানিয়ে গেছে বিরহ-কাতরতা; কবি যে ‘চৈতী হাওয়া’র বর্ণনা দিয়েছেন এই কবিতায় তা কবির জীবনে আজ গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। অনেকেই ধারণা করে থাকেন এই কবিতাটি কবির প্রথম জীবনের প্রেমী ও দুদিনে দুর্ঘটনার সঙ্গী, নার্গিস আসার খানম ওরফে সৈয়দা বেগম ওরফে দুবরাজকে নিয়ে রচিত। নজরুল তার নাম রেখেছিলেন, বসন্তের অমরাবতীর ফুল নার্গিস। কিন্তু কবির জীবনে এই নার্গিস ছিল একেবারে ক্ষণকালীণ। তবে নজরুল জীবনে নার্গিস যত ক্ষণকালীণই হোক, ‘চৈতী হাওয়া’র মতো অসাধারণ কবিতা বাংলা সাহিত্যে উদাহরণহীন। ১৯৩৭ সালে নজরুল নার্গিসের পত্রে যে জবাব দিয়েছিলেন তার সঙ্গে ‘চৈতী হাওয়া’ কবিতাটি মিলিয়ে পড়লে রচনার পটভূমি ও বিষয় বাস্তবতার কিছুটা সাক্ষাৎ মেলে। এই চিঠির শেষ একটি ছত্রের সঙ্গে ‘চৈতী হাওয়া’ কবিতার ১৫তম শেষ স্তবকটি আমরা পড়ে নিতে পারি— ‘জীবনে তোমাকে পেয়ে হারালাম, তাই মরণে পাব— সেই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রেমের ভুবনে তুমি বিজয়িনী, আমি পরাজিত। আমি আজ অসহায়। ’ ‘পরপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না, / এই তরীতে হয়তো পড়বে তোমার রাঙা পা। ’ এ ছাড়াও কবি এ পত্রে বিরহী প্রেমের প্রতীক লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদের উপমা নিয়ে এসেছেন। লাইলি-মজনুকে নিয়ে ভুবনখ্যান গানে তিনি একই সঙ্গে নার্গিস বুলবুল গোলাপ ও বসন্তের কথা বলেছেন— ‘দক্ষিণা বাতাস বহে অনুকূল/ ফুটেছে গোলাব নার্গিস ফুল/ ওগো বুলবুল, ফুটন্ত সেই গুলবাগিচায় দোলো। ’

আগেই বলেছি, নজরুলের বসন্ত আনন্দের নয়; অবশ্য রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, ‘রোদন-ভরা এ বসন্ত সখী কখনো আসেনি বুঝি আগে। ’ প্রকৃতপক্ষে বসন্তের যে চেতনা মানুষ তার হৃদয়ে ধারণ করে এই শঙ্কাময় পৃথিবীতে তার উপস্থিতি পাওয়া বড়ই দুষ্কর। এবার নজরুলের বিলাপময় বসন্তের কিছু চরণ চয়ন করা যাক:
১.     এ কুঞ্জে পথ ভুলি’ কোন বুলবুলি আজ গাইতে এলে গান / বসন্ত গত মোর আজ পুষ্প-বিহীন লতিকা বিতান॥
২.     আজো দখিনা হাওয়ায় ফাগুন জাগে/ বুলবুলি নাই গুলিস্তানে
৩.     ফুটলো যেদিন ফাল্গুনে হায়, প্রথম গোলাপ কুঁড়ি/ বিলাপ গেয়ে বুলবুলি মোর গেল কোথায় উড়ি
৪.     কেন মিলন-রাতে/ সজল আঁখি-পাতে/ কেন ফাল্গুন-প্রাতে/ সহসা বাদল ঝরে
৫.     ফাল্গুন ফুরায়ে যাবে— / উঠিবে নীরব শ্বাস চম্পার বনে/ কোয়েলা নীরব হবে

তবে এটি ভাবা উচিত হবে না যে নজরুলের বসন্ত রঙহীন ধূসর ও বিষণ্নতায় ভরা। নজরুলের আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈচিত্র্যময় সমৃদ্ধ জীবনের। যে জীবন ছিল ব্রজ গোপিনীদের আনন্দ ধাম, যে জীবন ছিল শহীদি ঈদগাহে— অর্থাৎ উৎসব ছিল তার রক্তে; আর উৎসব সর্বদা রঙিন, বহুবর্ণিল। তিনি, তার নিজের কথায়— ‘প্রেম পেতে এসেছিলেন, প্রেম দিতে এসেছিলেন। ’ প্রেমের রঙ আবীর, নজরুলের কথা ‘পিরিতি ফাগ মাখা, গোরির সঙ্গে/ হোলি খেলে হরি উন্মাদ রঙ্গে/ বসন্তে এ কোন্ কিশোর দুরন্ত/ রাধারে জিনিতে এলো পিচকারি হাতে। ’ কিংবা ‘রঙ্গিলা আপনি রাধা/ হরি তারে রঙ দিও না/ ফাগুনের রানী যে রাই/ তারে রঙে রাঙিও না। ’ নজরুল নিজেকে বসন্তের বার্তাবাহক গানের পাখিদের সহযাত্রী মনে করতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা আর একটি পত্রে তিনি বলেন, ‘কোকিল, পাপিয়া, বৌ-কথা কও, নাইটিঙ্গেল, বুলবুল— বিউটিফুল বলে এদের কেউ বদনাম দিতে পারেনি। কোকিল তার শিশুকে রেখে যায় কাকের বাসায়, পাপিয়া তার শিশুর ভার দেয় ছাতার পাখিকে। ‘বৌ-কথা কও’ শৈশব কাটায় তিতির পাখির পক্ষপুটে। তবু আনন্দে গান গেয়ে গেল এরাই। এরা ছন্নছাড়া কেবলই ঘুরে বেড়ায়, শ্রী নাই, সামঞ্জস্য নাই, শুনি নাই, কোথায় যায়, কোথা থাকে— ভ্যাগাবন্ড এক নম্বর। তবু এরাই স্বর্গের ইঙ্গিত এনে দিল। ’ নজরুলের এই স্বর্গই পৃথিবীতে বসন্ত— যা কেবল আনতে পারে কবি আর গানের পাখি কোকিল-বুলবুল। নজরুলের চেতনায় বসন্ত যেমন ঋতুর রাজা তেমন প্রেমের ধারক; রবীন্দ্রনাথ যেমন মদনভস্মের আগে ও পরে রচনা করে প্রেমের দেবতাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ভাবনা তুলে ধরেছিলেন; তেমনি নজরুল তার সিন্দু-হিন্দোল গ্রন্থের  ‘ফাল্গুনী’ কবিতায় মদন মাখা তূণের অধিকারী ফাল্গুনকে খুনী হিসাবে অভিহিত করেছেন।

নজরুল প্রেমিক কবি যৌবনের কবি। যৌবন একদিকে রুদ্র-ক্ষ্যাপা, ধ্বংস মাতাল— যেখানেই বৈষম্য, অন্যায়, জুলুম নির্যাতন, প্রেমে ও মিলনে বাধা— সেখানেই তার প্রতিবাদ। তাই নজরুলের বিদ্রোহের পাশে তার বসন্তের চেতনা বেমানান হয়নি। নজরুল প্রকৃতির সন্তান; প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে তার চেতনালোক একই মাত্রায় খাপ খাইয়ে নিয়েছে। আইরিশ কবি ডব্লিউ.বি ইয়েটস তার এক কবিতায় বলেছিলেন, ‘ওগো প্রিয়তম, দিকে দিকে আমি ছড়িয়ে ছিলাম, প্রকাশিত হয়েছিল আমার ইঙ্গিত; তবু তুমি আমার কাছে আসতে পারনি, এতে আমার দোষ কী? বসন্তের বনভূমিকে জিজ্ঞাস করো, সে আমার সন্ধান জানে; আমার সন্ধান জানে হেমন্তের গোধূলি। ’ নজরুলও তার কবিতায় গানে বসন্ত প্রকৃতির সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্কের পারসনিফিকেশন তৈরি করেছিলেন। বাংলা-কাব্যে বর্ষার পারসোনিফিকেশন রবীন্দ্রনাথের দান, আর নজরুল বসন্তের আবিষ্কারক।

আজ অতি নগরায়নের যুগে বসন্ত আমাদের সব সময় ধরা দেয় না। সকল নগরের চরিত্র এক; প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে তার কিছু আসে যায় না। মোবাইল কোম্পানি আর ফ্যাশন হাউজগুলো বিজ্ঞাপিত না করলে ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’ বলা ছাড়া নাগরিকদের কিছুই করার থাকতো না। তবু চূড়ান্তভাবে মানুষ প্রকৃতির সন্তান; প্রকৃতির আনন্দযজ্ঞে যোগ দিতে না পারলে মানুষের প্রজন্ম ব্যাহত হবে। সেই প্রতিবন্ধকতার দিনে, সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে নজরুল আসতে পারে রুদ্র-ভীম মূর্তিতে; আবার অত্যাচারির খড়্গ থেমে গেলে, জুলুমের অবসান হলে— বসন্তের স্নেগ্ধ দখিনা সমীরণ নিয়ে রঙের পিচকারি হাতে ব্রজগোপিদের মাঝে নজরুল পুনরায় ফিরে আসতে পারে। মানুষের পৃথিবীতে কে আর তার প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করবে!

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।