ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা নেই রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৯
ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা নেই রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ

রাঙামাটি থেকে ফিরে: প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ নেই রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের। ইতোমধ্যে একটি ব্যাচের ইন্টার্নশিপ করার সময় এসে গেছে, সেশনজটের দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। এছাড়াও শিক্ষক সংকটে রয়েছে মেডিকেল কলেজটিতে। রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরাও ক্লাস নেন সেখানে। আর হাসপাতালটিও চলছে চরম অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে।

নিয়মানুসারে ইন্টার্নশিপ করার জন্য মেডিকেল কলেজের অন্তর্গত একটি ২৫০ শয্যা সম্পন্ন হাসপাতাল থাকতে হবে। কিন্তু রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে রয়েছে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল।

হাসপাতালটি ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ছিলো, ভবনের সংস্কার ছাড়াই এটিকে ১০০ শয্যায় রূপান্তরিত করা হয়েছে।

ইন্টার্নশিপ করতে না পারলে এই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা চিকিৎসক হিসেবে সার্টিফিকেট পাবেন না। ফলে তাদের রয়েছে সেশনজটের আশঙ্কা। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ইন্টার্নশিপ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে নব্য প্রতিষ্ঠিত এ মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের। এছাড়া রাঙামাটি সদর হাসপাতালটির ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীত করার প্রস্তাবনা থাকলেও তার কাজ এখনো শুরু হয়নি।

সংশ্লিষ্টদের মতে ২০২০ সালের মধ্যে এই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে তাদের ইন্টার্নশিপ করতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সুযোগ নেওয়া লাগবে। সে ক্ষেত্রে সরকারি অর্ডার পাওয়াও একটি দীর্ঘমেয়াদী বিষয়।

এছাড়া রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে মূলত চিকিৎসা বিজ্ঞানের বেসিক বিষয়গুলোর শিক্ষক নেই। সর্বমোট ৪৮ জন শিক্ষক থাকলেও তাদের দিয়ে সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা চালানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন মেডিকেল কলেজটির শিক্ষকরা। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরাও শিক্ষা প্রদানের কাজে অংশগ্রহণ করেন বলে জানা গেছে।
২৫০ শয্যার হাসপাতাল থাকার কথা থাকলেও রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল ১০০ শয্যারএসব সমস্যা ছাড়াও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের আবাসনের সুবিধা নেই বলে জানিয়েছেন রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের একাধিক শিক্ষক। বাংলানিউজকে তারা বলেন, একটি মেডিকেল কলেজের প্রতিটি শিক্ষার্থীর অনুকূলে পাঁচটি করে হাসপাতালের শয্যা থাকা সরকারি নিয়ম। সে অনুসারে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল থাকতে হবে। না হলে ইন্টার্নশিপ করা যাবে না। তাছাড়া মেডিকেল কলেজ স্থাপনের আগেই এই হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের আড়াইশো শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হওয়ার খবর জানানো হলেও আজ পর্যন্ত তার কাজ শুরু হয়নি। তাই শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থা বা সার্টিফিকেট প্রাপ্তি নিয়ে আমরা যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় রয়েছি।

শিক্ষকরা আরো বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করা যাবে কিন্তু সেটার জন্য সরকারি অর্ডার লাগবে। সেটাও অনেক দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এর মধ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারির মধ্যে ইন্টার্নশিপের কি সুযোগ সৃষ্টি হবে তা নিয়ে আমরা সবাই দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করছি। আর ব্যাপকভাবে শিক্ষক সংকট রয়েছে এখানে। এক বিভাগের শিক্ষক অন্য বিভাগে গিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। এছাড়াও সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরাও বিভিন্ন ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব পালন করছেন। এভাবে সঠিক পাঠদান সম্পন্ন করা হয়তো পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে সম্ভব হচ্ছে না। তাই এখানে শিক্ষক বাড়ানোও জরুরি। আবার ছাত্রদের আবাসন ব্যবস্থা খুবই নাজুক। হাসপাতালে চিকিৎসকদের জন্য যে থাকার ব্যবস্থা ছিল সেটিও জীর্ণশীর্ণ একটি ভবন। ওই ভবনটিতে শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সর্বোপরি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ৫১ জন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এখনো অজানা।

এদিকে নাজুক অবস্থায় চলছে ওই ১০০ শয্যাবিশিষ্ট রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল বা সদর হাসপাতাল। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় হাসপাতালটির অব্যবস্থাপনার চিত্র।

হাসপাতালে ৩১ জন চিকিৎসকের পোস্ট থাকলেও বর্তমানে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১৪ জন। এছাড়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক নার্সেরও অভাব রয়েছে হাসপাতালটিতে। হাসপাতালটিতে রোগীর চাপ বেশি থাকে থাকায় ব্যবস্থাপনাতেও দেখা গেছে বেশকিছু গণ্ডগোল।  

জানা গেছে, রাঙামাটি শহরের সবচেয়ে দুর্বল বা জরাজীর্ণ ভবন হচ্ছে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল ভবনটি। ১৯৮৫ সালের ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় দুর্দশাসহ হাসপাতালজুড়ে নোংরা পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে। তাছাড়া হাসপাতালটিতে নেই অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ৩০০ থেকে ৪০০ রোগী আউটডোর সেবা নিয়ে থাকেন। হাসপাতালটি তৈরি করা হয়েছিলো ৫০ শয্যাবিশিষ্ট করে। রোগীদের ব্যাপক চাপের কারণে হাসপাতালের ভবন বৃদ্ধি করা ছাড়াই হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১১০ জন রোগী এই হাসপাতলে ভর্তি থাকেন। এক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় প্রায় হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষকে। তবে হাসপাতালটিতে নার্সের সংকট থাকলেও প্রায় ৭৭ জন ডেপুটেশনে প্রশিক্ষণরত নার্সরা কর্মরত রয়েছেন। এদিকে সারাদেশে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ বন্ধ থাকার কারণে হাসপাতালটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কর্মীদের অভাব রয়েছে বলেও জানা গেছে।

গত শনিবার (২০ এপ্রিল) রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল দিতে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালে নার্সের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও মহিলা ওয়ার্ডে অন্য আরেকজন অপরিচিত পুরুষ একজন রোগীকে হাতে ক্যানোলা পরাচ্ছেন। অদক্ষ হওয়ায় ক্যানোলা পড়াতে গিয়ে রক্ত বের হয়ে আসছিলো রোগীর। সে সময় কর্মরত নার্সকে ওই ওয়ার্ডে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং ওই ব্যক্তির পরিচয়ও জানা যায়নি। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলে নার্স সেখানে উপস্থিত হন এবং রোগীর দেখভাল করেন।

এদিকে হাসপাতালটির পুরুষ ওয়ার্ডের বাথরুম ব্যবহারের একেবারে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নোংরা বাথরুমেই বাধ্য হয়ে রোগীদের গোসল করতে ও টয়লেট ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তবে মহিলা ওয়ার্ডের বাথরুমটি তুলনামূলক পরিষ্কার ছিলো। পুরুষদের বাথরুমে মহিলাদের ও মহিলাদের বাথরুমে পুরুষদের গোসল করতে ও টয়লেট ব্যবহার করতে দেখা গেছে। যা অত্যন্ত বিপদজনক বলে মনে করেন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের সবাই। এক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনার দাবি জানান তারা।  

হাসপাতালটিতে ওষুধ প্রদানের ক্ষেত্রে ‘ঘাপলা’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেন এলাকাবা। রাঙ্গামাটি শহরের বাসিন্দারা জানান, হাসপাতাল থেকে সব ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় তাদের কাছে কিছু ওষুধের সংকট রয়েছে, এছাড়া যে ওষুধগুলো আছে সবই সরবরাহ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, জলাতঙ্কের জন্য গত দুই মাস আগে ৫০০টি ইনজেকশন আনা হয়েছিলো। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে মাত্র ৭০টি ইনজেকশনের ভায়াল রয়েছে। দিনে ১০ থেকে ১৫ জন জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত রোগীর আসে। এসব কারণ ছাড়াও এখানে ওষুধ আসতেও কিছুটা বিলম্ব হয়।

সামগ্রিক বিষয়ে রাঙামাটি জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী বাংলানিউজকে বলেন, মেডিকেল কলেজটির বিষয়ে আসলেই আমরা শঙ্কিত। খুব দ্রুত এই আড়াইশো বেড হাসপাতালটি স্থাপন হওয়া জরুরি নইলে শিক্ষার্থীরা সঠিক সময়ে সার্টিফিকেট পাবে না। যদিও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল তৈরির স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে, এমনকি ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজ শুরু হচ্ছে না। এক্ষেত্রে অন্য হাসপাতলে ইন্টার্ন করার জন্য সরকারি অর্ডার নেওয়ার বিষয়টিও ব্যাপক সময়সাপেক্ষ। আবার ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের ইন্টার্ন শুরু করতে হবে।

তিনি বলেন, সরকারিভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। যে কারণে আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কর্মীদের ব্যাপক সংকট। হাসপাতালটির ওয়ার্ডগুলোতে মাত্র দুইজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কর্মী রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা খুবই অপ্রতুল। নিয়মিত পরিষ্কার করা হলেও রোগীদের ব্যাপক চাপের কারণে তা বজায় রাখাটা একটু কঠিনই হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে আমরা আরো যত্নবান হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। আর জনবলের সংকটের কারণে মাঝেমধ্যে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। তবে এ ব্যাপারে আমরা কঠোরতা অবলম্বন করি।

অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ২০টি এক্সটিংগুইশার কেনা হয়েছে যা খুব দ্রুত স্থাপন করা হবে বলেও জানান রাঙামাটি জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী।  

বাংলাদেশ সময়: ১০১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৯
এমএএ/এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।