সবার জন্য ন্যায্যতার ভিত্তিতে চিকিৎসায় ব্যবহৃত (মেডিক্যাল) অক্সিজেন নিশ্চিত করতে আরও শক্তিশালী সুশাসন ও বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ অক্সিজেন সামিট।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আইসিডিডিআর,বির উদ্যোগে দিনব্যাপী অক্সিজেন সামিট ২০২৫-এ এ আহ্বান জানােনা হয়।
‘সবার জন্য নিরাপদ, সুলভ ও নির্ভরযোগ্য মেডিক্যাল অক্সিজেনের জাতীয় রোডম্যাপ’ বিষয়ক প্রতিপাদ্যে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে নীতিনির্ধারক, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন সহযোগী, বেসরকারি খাত ও সরকারি প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
এ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, সবার জন্য অক্সিজেন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মো. সাইয়েদুর রহমান।
অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন আইসিডিডিআর,বির সিনিয়র বিজ্ঞানী (ইমেরিটাস) এবং দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ কমিশন অন মেডিক্যাল অক্সিজেন সিকিউরিটির অন্যতম জ্যেষ্ঠ লেখক ড. শামস এল আরিফীন।
আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ড. আহমেদ এহসানুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষণার ফলস্বরূপ ২০২২ সালে এই কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কমিশনে একাডেমিয়ার ১৮ জন বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক, চিকিৎসা সেবাদানকারী ও জনস্বাস্থ্য পেশাজীবীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে ৪০ জন উপদেষ্টা কাজ করছেন। কোভিড-১৯ মহামারির মতো বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জরুরি পরিস্থিতিতেও যেন অক্সিজেনের অভাবে কারও মৃত্যু না হয়, সেই লক্ষ্য নিয়ে কমিশন কাজ করছে।
কমিশনের বৈশ্বিক বিশ্লেষণ অনুসারে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৩৭৩ মিলিয়ন মানুষের চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। এদের মধ্যে ১০৫ মিলিয়ন তীব্র অসুস্থতার জন্য, ২৫৯ মিলিয়ন অস্ত্রোপচারের সময় এবং ৯ মিলিয়ন দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্য অক্সিজেনের ওপর নির্ভরশীল। যাদের অক্সিজেন প্রয়োজন, তাদের পাঁচজনের মধ্যে চারজনেরও বেশি বাস করেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। হাইপোক্সেমিয়া (রক্তে অক্সিজেনের অভাব) মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় পাঁচগুণ বাড়িয়ে দেয়, অথচ এই দেশগুলোতে প্রয়োজনের সময় খুব কম রোগীই অক্সিজেন পেয়ে থাকেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মেডিক্যাল অক্সিজেনকে একটি অপরিহার্য ওষুধ হিসেবে ঘোষণা করেছে, যা স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবুও বিশেষ করে স্বল্প-সম্পদযুক্ত এলাকাগুলোতে এর সহজলভ্যতা বিশ্বজুড়ে এখনও অসমান। বাংলাদেশেও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে অক্সিজেনের ঘাটতি রোগীর যত্নে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে।
সম্মেলন থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশের অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে আইসিডিডিআর,বির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রেসার সুইং অ্যাডসর্পশন (পিএসএ), ভ্যাকিউম সুইং অ্যাডসর্পশন (ভিএসএ), এবং ভ্যাকিউম ইনসুলেটেড ইভাপোরেটর (ভিআইই) প্ল্যান্ট স্থাপন করার ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হলেও কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে। ৯৯টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পরিচালিত এক জরিপে কারিগরি রক্ষণাবেক্ষণ, জনবল ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত দুর্বলতা দেখা যায়, যা অক্সিজেন পরিষেবার নির্ভরযোগ্যতাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এই গবেষণাটিতে প্ল্যান্টের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বায়োমেডিকেল কর্মী তৈরি, বিকেন্দ্রীকৃত মেরামত সুবিধা স্থাপন, অক্সিজেনকে অপরিহার্য জনস্বাস্থ্য পরিষেবা হিসেবে স্বীকৃতি এবং একটি স্থিতিস্থাপক মিশ্র-সরবরাহ মডেলের প্রচলনের জন্য একটি জাতীয় রোডম্যাপ প্রণয়নের আহ্বান জানানো হয়।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মো. সাইয়েদুর রহমান বলেন, অক্সিজেন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি রয়েছে, তবে সরকার এটি দূর করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। আমরা একটি জাতীয় অক্সিজেন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা এবং অক্সিজেনকে অপরিহার্য ওষুধ হিসেবে ঘোষণার জন্য কাজ করছি। মেডিক্যাল অক্সিজেনের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
সভাপতির বক্তব্যে আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, অক্সিজেন উৎপাদনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে, তবে আরও অনেক কাজ বাকি আছে। নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে শক্তিশালী সুশাসন, বিভিন্ন সেক্টরের মধ্যে উন্নত সমন্বয় এবং সিস্টেম-জুড়ে পর্যবেক্ষণে টেকসই বিনিয়োগ প্রয়োজন। অক্সিজেন ব্যবস্থায় সুশাসন জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে। এই অগ্রগতি বজায় রাখতে সাশ্রয়ী সমাধান এবং প্রমাণ-ভিত্তিক নীতি প্রণয়নের জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনে অবিচ্ছিন্ন বিনিয়োগ অপরিহার্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, অক্সিজেন কেবল একটি পণ্য নয়, এটি একটি জনসেবা।
সম্মেলনে অক্সিজেন চাহিদা ও সরবরাহ, উৎপাদন ও বিতরণ প্রক্রিয়া, নীতি ও বিনিয়োগের অগ্রাধিকার এবং টেকসই সমাধানের জন্য উদ্ভাবন নিয়ে বৈজ্ঞানিক সেশন অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ইউনিসেফ, ইউএনওপিএস, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা জাতীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
সমাপনী অধিবেশনে নিম্ন-সম্পদযুক্ত এলাকাগুলোতে শ্বাসযন্ত্রের যত্ন উন্নত করার জন্য তৈরি স্থানীয়ভাবে বিকশিত কিছু প্রযুক্তি যেমন বাবল সিপ্যাপ, অক্সিজেট, নিঃশ্বাস ভেন্টিলেটর এবং কম খরচের অক্সিজেন কনসেনট্রেটর প্রদর্শন করা হয়।
সম্মেলনের বিশেষজ্ঞরা জোর দেন যে অক্সিজেন প্রাপ্তি জাতিসংঘের আটটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে মাতৃমৃত্যু (এসডিজি ৩.১), নবজাতক ও শিশু মৃত্যু (৩.২), এইচআইভি/এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া (৩.৩), অসংক্রামক রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য (৩.৪), মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার (৩.৫), সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু (৩.৬), সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ (৩.৮) এবং পরিবেশ দূষণজনিত মৃত্যু (৩.৯)।
দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ, এভরি ব্রেথ কাউন্টস ও ইউনিটাড-এর সহায়তায় আয়োজিত এই সামিট মেডিক্যাল অক্সিজেনকে মানবাধিকার এবং জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সম্মিলিত আহ্বান নিয়ে শেষ হয়।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা একমত হন যে, অক্সিজেনের সমতাপূর্ণ প্রবেশাধিকার কেবল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্থিতিস্থাপকতার জন্যই নয়, বরং ভবিষ্যতের জরুরি অবস্থার জন্য দেশের প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।
আরকেআর/এইচএ/